৬ নভেম্বর ২০২৫

সংরক্ষিত বনের কাঠে ফার্নিচার ব্যবসা, নেই বনবিভাগের অনুমতিপত্রও!

বাংলাধারা প্রতিবেদক »

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার অবস্থান পার্বত্য তিন জেলার পাশাপাশি। সেই সুবাদে গহীন অরণ্য থেকে বনবিভাগকে ‘আই ওয়াশ’ করে দেদারসে ঢুকছে পাহাড়ি বিভিন্ন প্রজাতির নিষিদ্ধ কাঠ। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব নিষিদ্ধ কাঠ ব্যবহার হচ্ছে লোহাগাড়ার অসংখ্য ফার্নিচার দোকানে। আবার এসকল দোকানে নেই বনবিভাগের বৈধ কাগজপত্রও!

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতী ইউনিয়নের পাশঘেঁষে লোহাগাড়ার নাপারটিলা বাজারের অবস্থান। এই বাজারের আলম ফার্নিচারসহ ৬টি দোকানে চলছে অবৈধ কাঠ দিয়ে ফার্নিচার তৈরির রমরমা ব্যবসা। শুধু তাই নয়, এসব দোকানের নেই বন বিভাগের অনুমতিপত্রও (লাইসেন্স)।

ওই বাজারের উল্লেখযোগ্য দোকানগুলো হলো— আবদুল আলম কোম্পানির মালিকানাধীন ‘আলম ফার্নিচার,’ মিজানুর রহমানের মালিকানাধীন ‘মোহাম্মদিয়া ফার্নিচার’, খানে আলম ও মো. রাসেলের মালিকানাধীন ‘শাহ্ মজিদিয়া ফার্নিচার’, কামাল হোসেনের মালিকানাধীন ‘কামাল ফার্নিচার’।

অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব ফার্নিচার দোকানে বিক্রি নিষিদ্ধ কাঠের আসবাবপত্র তৈরি হচ্ছে। যদিও এসব দোকানে বনবিভাগের বৈধ কাগজপত্র নেই। স্থানীয় কতিপয় সাংবাদিক সিন্ডিকেটকেও মাসোহারা দিতে হয় এসব ব্যবসা করতে। ফলে সেসকল সাংবাদিকরাও মাসোহারা পেয়ে ব্যবসায়ীদের হয়ে ‘দালালি’ করে বেরায়।

স্থানীয় কাঠ পাচারকারীদের একটি সক্রিয় সিন্ডিকেটের যোগসাজশে এ অবৈধ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কাঠ পাচারে দৈনিক লক্ষ টাকার অবৈধ লেনদেন করেন তারা। এদিকে, মাসোহারা পেয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে বনবিভাগ। এতে লোহাগাড়া, কেরানীহাট, চুনতি, লামা, আলীকদম ও কক্সবাজার জেলার বিশাল বনভূমি দিনে দিনে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। অবাধে বৃক্ষ নিধনে পরিবেশের ভারসাম্য নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, আজিজনগর, আধুনগর, চুনতি, হারবাং, ফাইতং থেকে চোরাই পন্থায় আনা এসব কাঠ ফার্নিচার দোকানে সরবরাহ করে দেয় স্থানীয় কাঠ পাচারকারী চক্র। লোহাগাড়ার পদুয়া ও আধুনগর, সাতকানিয়ার কেরানীহাট এবং বান্দরবানের আজিজনগর থেকে চোরাই কাঠ, ফার্নিচার ও চিরাই কাঠ ভর্তি কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাচ্ছে নলবিলা চেক স্টেশন পেরিয়ে।

বনবিভাগের বনকর্মীরা লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে চোরাই কাঠ ভর্তি ট্রাক, পিকআপ আটক করলেও সিংহভাগ কাঠ আত্মসাত ও মোটা অংকের টাকা বিনিময়ে পরে আটক গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ফরেস্ট চেক পোস্ট হয়ে কক্সবাজার বনবিভাগ, চকরিয়া, জোয়ারিয়ানালা, রামু, ঈদগাঁও প্রভৃতি এলাকা থেকে ট্রাকে তেরপাল ঢেকে লবণ, বালু, মাছ পরিবহনের আড়ালে পাচার হচ্ছে মূল্যবান কাঠের রদ্দা ও গোল কাঠ।

এমনই অবৈধ কাঠ পাচারের অন্যতম হোতা লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুল আলম কোম্পানি। নাপারটিলা বাজারে মালিকানাধীন একটি ফার্নিচার দোকানও রয়েছে তার। স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৬ নভেম্বর নাপারটিলা বাজারে অভিযানে যায় বনবিভাগ। বন কর্মকর্তারা গিয়ে জানতে পারেন নাপারটিলা বাজারের একটি ফার্নিচার দোকানেরও বৈধ কাগজপত্র নেই।

তবে, শুধুমাত্র আব্দুল আলম কোম্পানির মালিকাধানাধীন দোকানই বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। বাকি দোকানগুলো অনুমতিপত্র (লাইসেন্স) ছাড়াই দেদারছে চালাচ্ছে ব্যবসা। আবার, লাইসেন্স না করা পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনার পরেও বন বিভাগের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবদুল আলম দোকান চালু রেখেছেন। করেননি কাগজপত্রও সংগ্রহও।

বনজদ্রব্য পরিবহন (নিয়ন্ত্রণ) ২০১১ বিধিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া কাঠের ফার্নিচার তৈরি, বিক্রি বা ব্যবসা পরিচালনা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এতে কোনো ব্যক্তি ওই আইন অমান্য করলে বন আইনের ৪১ ও ৪২ ধারামতে, তাঁকে নিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। অনাদায়ে পাঁচ হাজার টাকা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আলম ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী আবদুল আলম বাংলাধারাকে বলেন, ‘রেঞ্জার স্যার আমার অফিসে এসে ঘুরে গেছেন। আমার দোকান চেক করে তিনি কোনও সেগুন কাঠ পাননি। শুধু লাইসেন্স করিয়ে নিতে বলেছেন। আর আমার তো লাইসেন্স আছে। লাইসেন্সের মেয়াদ চলে গেছে আর কি। ওটা নবায়ন করতে হবে। লোহাগাড়ায় মিনিমাম হাজারখানেক ফার্নিচার দোকান আছে। ৪-৫ টি দোকান ছাড়া বাকিদের লাইসেন্স আছে বলে আমার মনে হয় না।’

তিনি বলেন, ‘আর এখন তো বনের কাঠ কাটার কোনো সুযোগ নেই। টংকাবতী পাহাড়ের ওদিকে কিছু গাছ কাটে আর কি। লোহাগাড়ায় বনের কাঠ কাটার উপায় নেই। কারণ, এখানকার সব প্রভাবশালীরা বনবিভাগের অধীনে ফরেস্ট ভিলেজার হিসেবে আছেন।’

লাইসেন্স ছাড়া ফার্নিচার ব্যবসা অবৈধ স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি জানি এটি। উপজেলার বড় বড় দোকানেও লাইসেন্স নেই। তাই আমিও এতদিন করিনি। এখন লাইসেন্স করব, এটি প্রক্রিয়াধীন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস শুক্কুর বলেন, ‘ওরা বন থেকে অবৈধ কাঠ এনে ফার্নিচার তৈরি করে। বনবিভাগের লোকজন আসার পর পারমিশন দেখাতে পারেনি। পরে দোকানগুলো বন্ধ রাখতে বলছে। বিষয়টা আমাকে দেখতে বলেছেন রেঞ্জার স্যার। এখনও দোকানের মালিকরা আমার কথা না শুনে দোকান খোলা রাখছে। আমি বিষয়টি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে জানিয়েছি।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে রেঞ্জ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বাংলাধারাকে বলেন, ‘আমরা অভিযানে গিয়ে অবৈধ কাঠ পাইনি। তবে তাদের অনুমতিপত্র নেই। ওখানে আমাদের বিট অফিসার গিয়েছিল। দোকান সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি চাচ্ছি তাদেরকে অনুমতিপত্রের আওতায় আনার জন্য। আমি তাদেরকে ফোন করে বলেছি আপনারা সরকারি বিধিমালা ভঙ্গ করবেন না।’

রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, ‘এরপরেও কেউ যদি নিয়মভঙ্গ করে দোকান চালু করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওখানে যারা দোকানদারি করে তাদের কারও লাইসেন্স নেই। আমি কালকে (সোমবার) ফিজিক্যালি যাবো। গিয়ে লাইসেন্স ছাড়া দোকানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

বাংলাধারা/আরএইচআর

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ