ফেরদৌস শিপন »
দুনিয়ার অমোঘ বিধান, জন্মিলে মরতে হবে। আমাদের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে, এটাই সত্যি। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু এমন, যা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। তেমনি একজন নাম মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন। গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চেন্নাইয়ের একটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। খবরটি শোনার পর চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। যিনি আমাকে সাংবাদিকতার স্বরলিপি শিখিয়েছেন। মূলধারার সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। মফস্বল সাংবাদিকতার এই পথিকৃৎ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সংবাদপত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। এককথায় সাংবাদিক গড়ার কারিগর।
সাংবাদিকতা জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজের মেধা, যোগ্যতা ও শ্রমের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন চিন্তা ও মননে আধুনিক। সহকর্মী, জ্যেষ্ঠ ও অনুজ ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তার চিন্তা-চেতনাকে ঋদ্ধ করেছে। সাংবাদিকতায় শুদ্ধতা গ্রহণের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য ছিল না তার। সাংবাদকিতায় নৈতিকমান অনুসরণের ব্যাপারে তিনি কখনও পিছপা হননি। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। তাঁর পেশাদারিত্ব আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো। বর্তমান সময়ের সাংবাদিকদের মধ্যে যে ধরনের রাজনৈতিক দলবাজি হয়, সেই ধরনের নোংরামি থেকে তিনি নিজেকে অনেক দূরে রেখেছিলেন। লো প্রোফাইল মেইনটেইন করতেন। নিম্নকণ্ঠের মানুষ ছিলেন। প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন, উদীয়মান সাংবাদিকদের অনুপ্রেরনা ছিলেন।
তার একক প্রচেষ্টায়, দক্ষতায়, সীমাহীন যোগ্যতা এবং মেধার জোরে ‘মাসিক মিরসরাই’ ও সাপ্তাহিক ‘বন্দর নগরী’ নামের দুটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের জায়গা নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে দিয়ে ‘মাসিক মিরসরাই’ পত্রিকার কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছিলেন। সাংবাদিকতার প্রায়োগিক জায়গায় তিনি ছিলেন অনন্য। আমার কাছে তিনি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। নতুন প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবেন। এই পেশার প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। পেশাগত উৎকর্ষের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। ছিলেন একজন সাংবাদিক, সম্পাদক ও কলামিস্ট হিসেবেও। ছিলেন একজন স্বপ্নবান মানুষ। মিরসরাই প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বহুদিন। এলাকার সমস্যা সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছেন লেখনীর মাধ্যমে। তাঁর লেখার ফলেই চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সব দিকে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে।
মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের সম্পাদনায় ‘মাসিক মিরসরাই’ বের হতো। তাঁর হাত ধরে আমি সাংবাদিকতায় এসেছি এবং শিখেছি। শিখেছি সাংবাদিকতার বিভিন্ন পরিভাষা। তিনি আমাকে হাতে-কলমে শেখাতেন। নিয়মিত লেখার পাশাপাশি ঢাকা হতে প্রকাশিত দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমাকে। যেটি ছিলো কোন জাতীয় দৈনিকে আমার প্রথম কাজ৷ আমার মতো অনেক সাংবাদিকদের হাতেখড়ি হয়েছে ‘মাসিক মিরসরাই’ এর মাধ্যমে।
কীভাবে একটি প্রতিবেদনকে খুব সহজ ভাষায় পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা যায়, তা শিখেছি সম্পাদক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের কাছে।শিখেছি কীভাবে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন উপস্থাপন করলে তা নির্দোষ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতির কারণ হবে না। অসম্ভব কর্মপ্রিয় ও নির্ভেজাল হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি যা শিখিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করতে পারব না। আমার সাংবাদিকতা পেশায় আসার পেছনে একমাত্র মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিনই উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
নিজাম ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো ভুলিনি এখনো। ভোলা সম্ভবও নয়। সব সময় হাসিখুশি থাকা মানুষটা ছিলেন বন্ধু অন্তঃপ্রাণ। খুব মজা করতেন। তাঁর সামনে পড়লে অনেক হাসি ঠাট্টা রহস্য করতেন। প্রচণ্ড দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও প্রাণ খুলে হাসতে পারতেন। কর্মজীবনে বহু সাংবাদিক তৈরি করেছেন। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করেছেন তার অসংখ্য গুণগ্রাহী। তিনি কখনোই হারিয়ে যাবেন না, তার কাজের মাধ্যমে সকলের মাঝে বেঁচে থাকবেন। মিরসরাই এর সাংবাদিকতার ইতিহাস এ মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সবার মাঝে। তাঁর আত্নার শান্তির জন্য দোয়া করি। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করবেন। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা রইলো।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাধারা।