২৩ অক্টোবর ২০২৫

স্মৃতিকাতর আত্রাই নদীর চরের কচি বালক ও কর্মফল

সায়েম উদ্দীন »

কবি লিখেন। তাঁর লেখাটি কবিতা হয়ে উঠে কিনা তা ঋদ্ধ পাঠকের চিন্তার সুযোগ থাকলেও কবি এক্ষেত্রে ভাবলেশহীন। কবির প্রজ্ঞায় ধ্যানে মগ্ন মাথা থেকে বিচ্ছুরিত হয় বোধ ও বিশ্বাসের নানা অক্ষর সম্বলিত শব্দ। এই শব্দগুলোর সম্মিলিত বন্ধনই কবিতা। একেক মনিষী কবিতাকে একেকভাবে সংজ্ঞায়ন করে গেছেন। এই জায়গা থেকে একজন কবির প্রত্যেকটি লেখা কবিতা হয়ে ওঠে কিনা তা নিয়ে নানা যুক্তি-তক্ক বা টেবিল চাপড়ানো সময় ব্যয় করা যেতে পারে।

পাঠক যখন কবিতা পাঠে মনোনিবেশ হোন তখন কবির পেশা, নাম বা গ্রামকে নয় কবির সময়, যাপন কৌশল, কবিতার ব্যাকরণ ও কবিতার আঙ্গিককে প্রাধান্য দেন। নন্দন বইঘর থেকে প্রকাশিত মঈন ফারুক এর প্রচ্ছদে কবি রশিদুল ইসলাম এর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‌‘সেই কালপুরুষ’ পাঠক কবির বিশ্বাস ও যাপনকে অনুভব করার পাশাপাশি কবির সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনিয়মের প্রতি সোচ্চার প্রশ্নবাণ সংযুক্ত জীবনবোধ উপলব্ধি করবেন।

যেমন,
‘এক মিনিট সময়ের মূল্য একশত কোটি টাকা
কয় মিনিট আছে তোমার? কিনবে নাকি ঢাকা।… ’
(কবিতা: কোথায় তুমি)

‘.. সময়ের ঘন্টা বাজায় নগ্ন পায়ে নূপুরের ধ্বনি
পুরুষ শপিং ব্যাগের পলিথিন?
নাকি সমান্তরালের উপর জ্যামিতিক কোণ?’
(কবিতা : সমীকরণ)

বৃহত্তর মানুষ সমাজের মূল পরিচয় মানুষ হলেও স্বজাতি চেতনায় স্বচ্ছ ধারণা ও ভাবনা কবির ব্যক্তিযাপনকে প্রভাবিত করে। কবির এই গ্রন্থে বেশ ক’টি কবিতা জাতি ইতিহাস সচেতনতার প্রেক্ষিত বহন করে।

‘অপভ্রংশের চর্যাপদ থেকে উনিশ শ বায়ান্ন
বাঙালির রক্তের বিনিময়ে পাওয়া
বাঙলার উনপঞ্চাশ বর্ণ।

লাশগুলো কথা বলে
তিতুমীর, মুজিবের
বর্ণ খুঁজি বাঙলা ভাষার
বর্ণ খুঁজি পতাকা লাল সবুজের।’
(কবিতা : বর্ণ খুঁজি)

সময়কে ধারণ করার প্রচেষ্টা কবির বোধকে মুক্ত করেছে। শিকল ভাঙার তাড়না আর বন্দিযাপনকে বিষয়বস্তু করে লকডাউন নামক কবিতায় কবির বিবৃতি অবশ্যই প্রশংসার উপযুক্ত।
‘…. করনা তুমি ছলনা করে-
করছ কেন যুদ্ধ
লকডাউনে আইন কড়া-
এখন সবাই জব্দ।…’

করোনায় জব্দ সমাজকে কবিতায় উপস্থাপন করার চেষ্টা কবির জাগ্রতবোধের সাক্ষর বহন করে। ‘হাঁটতে দাও’ কবিতায় কবি নিজেকে সমাজ বাস্তবতা থেকে আলাদা এক সত্তা হিসেবে দাঁড় করান।

‘তোমাদের কাছে কী আছে?
আমি বারবার তাকাই….
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আবার খুঁজি
মনের ভেতর আঁকা ছবি’

‘কয়েকটা দিন…
তার জন্য এতো দাবি।
তুমি যাও আর আমি তোমার সঙ্গে
যাবো না। তুমি বড্ড পাজি! বলছি
খাবো না। তোমার বায়নার শেষ নেই।
তোমার কাছে আমার কী আছে?
আমি বারবার তাকাই।
আমি একা-
একাই হাঁটতে দাও
আমাকে হাঁটতে দাও।’
(কবিতা: হাঁটতে দাও?

কবিতায় যখন বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রণের অনুপাত সঠিক থাকে তখন সে কবিতা পেয়ে যায় শৈল্পিক রূপ। বোধশক্তির যোগে সেই রূপ পূর্ণতা পায়। এই পূর্ণতার রেশে কবি থামিয়ে দেন সমুদ্রগর্জন।

‘কূল ভাঙা নদীর তীর
বঙ্গোপসাগর আর আত্রাইয়ের মাঝে
যমুনার জলে স্নানের শুভ যাত্রায়
নিঝুম রাতে….
গর্জন শুনেছি সাপের
নেমে এসেছি ঝটিকায় নিম্ন-চাপের উদ্বেগে রাত্রি জেগে
শুনি সেই ভেসে আসা আওয়াজের ধ্বনি..
বেণু বাজিয়ে শোনায় মন সংগীতের কলরব।…’
(কবিতা: সমুদ্রগর্জন)

এমন পূর্ণতায়ও চিন্তার ভাঁজে ভাঁজে তৈরী হয় সংকট। চিন্তার সংকট। এমন সংকট যাপনে কবি ছুটেন পেছনে। শৈশবে অথবা বিশ্বাসের অদৃষ্ট সত্তার দিকে। বর্তমান আর অতীত কবিকে এক করে ফেলে।

‘লুসাই পাহাড়ে জন্ম
বঙ্গ-জননী তুমি কর্ণফুলী পরিচয়।…’

(কবিতা: কর্ণফুলী) কর্ণফুলীর মোহনায় চট্টগ্রাম শহরে ব্যস্ত থাকা কবি স্মৃতিতে কাতর তাঁর বেড়ে উঠা আত্রাই নদীতট নিয়েও।

‘ধামইর হাটের সীমান্তের প্রান্তে-
পড়ে থাকা আমি এক কচি বালক,
অভিনন্দন জানাই তোমাকে আত্রাই নদী
তুমি ঠাঁই দিয়ে করেছ আমায় আশার আলোক।..’
( কবিতা: আত্রাই নদীর চরে)

স্মৃতিকাতরতা কবির আবেগের সবল কিন্তু সরলতম সংকট সৃষ্টি করে বীজের অঙ্কুরোদগম হওয়ার যে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া এই পক্রিয়ায় অদৃষ্ট সত্তার স্থান ক্ষীণ। কিন্তু এই ক্ষীণ সত্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস কোনো কোনো সময় কবির কবিতাবোধকে দূর্বল করে ফেলে। ওই দূর্বলতম সময়ে বিবৃত হয় গ্রন্থটির প্রথম কবিতার মতো দুর্বলতম বিশ্বাসের কবিতা।

‘…শির-নোয়াতে তোমারি কাছে
নাহি হলো দ্বিধাবোধ।…’
(কবিতা: প্রার্থনা)

এই বিশ্বাসচেতনা সীমাবদ্ধ বা স্থির নয়। কবি বারবার এই বিশ্বাস থেকে সরেছেন, ফিরেছেন কিঞ্চিৎ।
‘চার আঙ্গুলের এ কপালের
দিও না দোষ
সবই কর্মফল।
(কবিতা : কর্মফল)

‘অতি ধীরে নিঃশব্দে হাঁটছি
তবু বুনো ঘাস থেকে ঝরে যায়
শিশির বিন্দু।
ভোরের লগ্ন শেষ হয়ে যায়।…’
(কবিতা: সেই কালপুরুষ)

কবি কবিতার সুষ্ঠু চিন্তায় কতটুকু অগ্রসর তা পাঠক নয় স্বয়ং কবিই ঠিক করবেন। কিন্তু ‘সেই কালপুরুষ’ শীর্ষক কবিতা পাঠের পর প্রায় পাঠক আমার সাথে একমত হবেন ‘সেই কালপুরুষ’ নামক গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে কবির একনিষ্ঠ যাপনের কৌশল। ওরিয়ন তথা কালপুরুষের খুঁজে কবি দাঁড়িয়ে আছেন সময়ের বিশ্বাস-বিজ্ঞান এর প্রতি দোদুল্যমান পরমতম বস্তুর উপর।

কবিতার বই: সেই কালপুরুষ
কবি: রশিদুল ইসলাম
প্রচ্ছদ : মঈন ফারুক
প্রকাশক: নন্দন বইঘর

আরও পড়ুন