বাংলাধারা ডেস্ক »
অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলে পরিচিতি চট্টগ্রামের ৫৪.২৯ শতাংশ ভবন। সামগ্রিকভাবে সারাদেশের ৩৮.৮৭ শতাংশ ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে থাকা এই সব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে অগ্নিঝুঁকি চিহ্নিত করা গেলেও এইসব ভবনকে কিভাবে নিরাপদ করা যায় তা নিয়ে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একাধিকবার সতর্ক করা হলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। শুধুমাত্র বড় কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সামনে এলে তখন কিছুদিন আলোচনা হয়, এরপর সেটাও থেমে যায়। আইনি ক্ষমতা না থাকায় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নিতে পারে না বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে এখনই প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। বড় কোনো দুর্ঘটনার পরে কিছুদিন আলোচনায় না রেখে সারা বছর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সমন্বিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হবে। একইসঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমিয়ে এনে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নাগরিকদের মাঝেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়াও বহুতল ভবনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে খুব দ্রুত এর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে পাঁচ হাজার ৮৬৯টি ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এর মাঝে দুই হাজার ২২৩টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার মাঝে দেখা যায়, ৬৭১টি অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং এক হাজার ৬০৬টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এই সময়ে অগ্নিনিরাপত্তায় ৩ হাজার ৯৬টি ভবনে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৫৪.৬৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে ১.৯৩ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে ৫৪.২৯ শতাংশ ভবনে। এছাড়া বরিশালে ২৯.৬২ শতাংশ, খুলনায় ৪১.৪৬ শতাংশ, রংপুরে ২৪ শতাংশ, সিলেটে ১৯.৭৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৪.৯৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ১.৯৩ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি এক হাজার ১৬২টি ভবন পরিদর্শন করে। এর মাঝে ৬৩৫টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। যার মধ্যে ১৩৬টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিবেদনে রাজধানীর ৫২৭টি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সন্তোষজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজার ৬৭৬টি ভবন পরিদর্শন করে ৯১০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। এ এলাকায় অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৪৬৩টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৪৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দৈবচয়নের ভিত্তিতে বা সাধারণত কিছু বিষয়কে প্রাথমিক মানদণ্ড মেনে এই ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়। এর মাঝে রয়েছে ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি খতিয়ে দেখা। এসব তথ্য পর্যালোচনা করা ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপরেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে মালিকদের চিঠি দেই। আমাদের কাজ সমস্যা চিহ্নিত করা, মানুষকে সচেতন করা। আমাদের কাজ বল প্রয়োগ করা নয়। যারা মানছে না আমরা তাদেরও চিহ্নিত করি। আইন প্রয়োগ করার জন্য অন্য সংস্থা রয়েছে।’
উল্লেখ্য, দেশে ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন ৫১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যান। একই বছর ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ৭০ জন আহত হন। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারান।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০৭ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। আর উদ্ধার করা মালামালের আনুমানিক মূল্য ১ হাজার ৮০৮ কোটি ৩২ লাখ ৬৪ হাজার ৬৬০ টাকা। এ ছাড়া ৯ হাজার ৫১৭টি অগ্নিকাণ্ডের অপারেশনে যাওয়ার আগে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
এসব অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে পুরুষ ৭২ জন ও নারী ১৩ জন। অগ্নিনির্বাপণে গিয়ে দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হয়েছেন ১৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০৭ জন। সূত্রে : সারাবাংলা












