২৭ অক্টোবর ২০২৫

মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা ক্ষতিগ্রস্তদের, অনুসন্ধান শুরু করেছে তদন্ত কমিটি

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আগুন নেবানোর পর খোলা আকাশের নিচে উদ্বাস্তুরা তাবু বা কাপড় মুড়ি দিয়ে কাটিয়েছে সারারাত।

সোমবার (৬ মার্চ) ভোর থেকেই ধ্বংসস্তুপ সরানোর কাজে হাত দেয় ক্ষতিগ্রস্তরা। আবারও পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাতে বাঁশ, পলিথিনের বেড়া ও ত্রিপল বসানোর উদ্যোগ শুরু করেছেন পরিবারের কর্তা ব্যক্তিরা। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন স্ত্রী, সন্তান ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরাও। আগুন সবকিছু নিঃশেষ করে দিলেও ধ্বংসস্তুপ থেকে প্রায় অক্ষত উদ্ধার হয়েছে আল কোরআন। একে আল্লাহর কুদরতি বলেই মন্তব্য করছেন ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।

ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, খুবই মন্দ ভাগ্য নিয়ে আমরা পৃথিবীতে এসেছি। নিজদেশ থেকে সামরিক জান্তা ও মগদের (রাখাইন) দ্বারা নিপীড়িত হয়ে বাস্তুচ্যুত ও দেশ তাড়িত হয়েছি। বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে ভালো মতো জীবন ধারণ করতে সহায়তা করছে। এর মাঝে আমাদের কওমের (জাতভাই) কিছু ভাই সন্ত্রাসের সাথে যোগ দিয়ে হত্যা, মাদক, অস্ত্র নানা অপকান্ডে যুক্ত হয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে আমার মতো লাখো নিরহ রোহিঙ্গার জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। অগ্নিকান্ডে (তার মতে উদ্দেশ্যমূলক) আশ্রিত জীবনের সর্বস্ব হারিয়েছি। বউ-বাচ্চা নিয়ে তো আর খোলা আকাশের নিচে থাকা যাবে না। বাংলাদেশ সরকার বা দাতা সংস্থা কখন দিবে তার দিকে তাকিয়ে থাকা নাফরমানি হবে। তাই যা পেয়েছি তা দিয়ে মাথার উপর ছায়া তোলার কাজ করছি।

ক্যাম্প-১১ এর আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ফাতেমা বেগম বলেন, দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরের বাইরে বসেছি- ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে আসরের আজান হলে নামাজ পড়ে আবার রাতের রান্নার যোগাড় করবো। এমন সময় ক্যাম্প ডি-১৪, বি-৪ ও ডি-৫ থেকে একই সময়ে আগুন জ্বলে উঠতে দেখি। সেখানে থাকা কওমরা যে যেভাবে পারে পালাতে শুরু করে। আগুন মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়লে কেউ কোন জিনিস পত্র ছাড়াই এদিক সেদিক দৌঁড়াচ্ছিল। তাদের সাথে আমিও পালিয়েছি- আশ্রিত চলমান জীবনের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। এখন কি দিয়ে মাথাগুজার ঠাঁই করবো তা নিয়ে দুচ্ছিন্তায় আছি।

এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে কাজ করছে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি। সোমবার (৬ মার্চ) দুপুর থেকে আনুষ্টানিক অগ্নিকাণ্ড স্থল পরিদর্শন দিয়ে রহস্য অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে জেলা প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটির সদস্যরা, এমনটি জানিয়েছেন তদন্ত টিমের প্রধান এডিএম মো. আবু সুফিয়ান।

এডিএম বলেন, দুপুরের পর তদন্তটিম পুড়ে যাওয়া ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। আমরা অগ্নিকান্ডের উৎসস্থল খোঁজার কাজ করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম, নানাভাবে যেখানে যে তথ্য প্রচার পেয়েছে সবকিছুর লিংক সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। সবতথ্যই আমাদের তদন্তের একটি অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে। ক্যাম্পে, ক্যাম্পের বাইরে, গণমাধ্যমকর্মীসহ সকলকে বলেছি, যারকাছে যে তথ্য আছে বলে মনে হবে তা যেন আমাদের সরবরাহ করে সহযোগিতা করা হয়।

 

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কামিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রবিবার বেলা ৩টার দিকে লাগা আগুন দীর্ঘ তিন ঘন্টার প্রচেষ্টায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। তখনই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তার সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গঠিত কমিটি আগামী তিন কর্মদিবসে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। গঠিত কমিটিতে জেলা পুলিশের একজন, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের একজন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একজন, ফায়ার সার্ভিসের একজন, গোয়েন্দার সংস্থার একজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্প-১১ এর একটি ব্লক মাঝি বলেন, আরসা সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিত ভাবে ক্যাম্প-১১’তে আগুন লাগিয়েছে। একসাথে বেশ কয়েকটি জায়গায় আগুন লাগানোর ফলে চতুর্দিক তা ছড়িয়ে পড়ে। তার দাবি, আরসার সদস্যরা অন্যান্য ক্যাম্পে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও ক্যাম্প-১১-তে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। হয়তো এ কারণে তারা ক্যাম্প-১১তে আগুন লাগিয়ে জাতি ভাইদের এভাবে ভোগান্তিতে ফেলেছে।

তার এ আশংকার সত্যতা মিলেছে ইউটিউবে কথিত আরসা নেতার উসকানিমূলক অডিওতে। গত শুক্রবার (৩ মার্চ) রোহিঙ্গাভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ‘রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস’-এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাতপরিচয় ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করে ক্যাম্পে যারা আরসাকে ‘দমনে’ জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন। এতে আরও বলা হয়, ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়। বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।

রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র বলেছেন, রবিবার (৫ মার্চ) বিকাল ৩টার দিকে আরসা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত জনৈক এহসান ও ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১১ এর ডি-এ ১৪ ও বি ব্লকে ১০-২০ জনের একটি সশস্ত্র দুর্বৃত্তদল ব্লকের একটি ঘরে প্রথমে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগপিছ সময়ে ডি-এ ব্লকসহ বি-ব্লকের একাধিক ঘরে আগুন জ্বলে উঠে। দ্রুত আগুন চারদিক ছড়িয়ে পড়লে আরসার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। আর আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণ রক্ষায় বসবাসরত রোহিঙ্গারা দিগবিদিক দৌঁড়ে পালায়। মুহুর্তে ক্যাম্পের বসত ঘর, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, দোকান, দাতা সংস্থার হাসপাতাল, সার্ভিস ও লার্ণিং সেন্টার পুড়ের ছাই হয়ে যায়।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সোমবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে ট্রানজিট কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে। গৃহহীন রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনে কাজ করছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদন পাবার পর জানা যাবে-রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের পেছনে নাকশতা ছিল কি না।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, অগ্নিকান্ডটি রহস্যজনকই মনে হচ্ছে। আগুন নেবানোর পর বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রচার পেয়েছে। যেখানে ঘরে আগুন লাগাস্থানে মানুষের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। যদিও ভিডিওতে সেইসব চেহারা স্পষ্ট নয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক রোহিঙ্গা কিশোরকে দেয়াশলাইসহ আটক করে জিজ্ঞাসাবদ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ কিশোরকে ঘরে আগুন দিতে দেখেছেন অনেকে- এমনটি প্রচার পাচ্ছে। তাকে হাতে-নাতে ধরা হয়েছে।

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২২২টি। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টি কারণ জানা যায়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরসাসহ তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং সাতটি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে। বেশির ভাগ ক্যাম্পের ওপর আরসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ২০২১ সালে ক্যাম্পে ২২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে ৩২টি।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ক্যাম্পে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী এলাকার তিনটি (ক্যাম্প-৮, ৯ ও ১১) আশ্রয়শিবিরে। ওই অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়। গৃহহীন হয়েছিল ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা গেছেন রোহিঙ্গা ৬ শিশুসহ ১৫ জন।

আর রবিবারের (৫ মার্চ) আগুনে পুড়েছে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের পৃথক তিনটি ব্লকের দুই হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বসতি (শেল্টার)। এর বাইরে শতাধিক দোকান, ২০টির বেশি বেসরকারি সংস্থার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদানের লার্নিং সেন্টার, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র, ৩৫টি মসজিদ-মাদ্রাসা ক্ষতিগ্রস্ত। গৃহহীন হয়েছে প্রায় ১২-১৫ হাজার রোহিঙ্গা। ঘটনার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামে সেনাবাহিনী, পুলিশ, এপিবিএন, ফায়ার সার্ভিসসহ কয়েক’শ স্বেচ্ছাসেবী। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও ভেতরে গিয়ে ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, তখনো ভেতরে বিকট শব্দে গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটছিল। সোমবার সকাল হতেই ধ্বংসস্তুপ সরানোর কাজ কিছুটা শুরু হয়। সন্তর্পণে এখন কাজ করা হচ্ছে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এছাড়াও প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন