৫ নভেম্বর ২০২৫

আয়াত, বর্ষা ও আয়নী নিখোঁজ, ফিরে লাশ হয়ে

মুহাম্মদ আব্দুল আলী »

এই শহরে শিশু নিখোঁজ হয়ে যায় একের পর এক। কিছুদিন পর তারা ফিরে আসে, তবে লাশ হয়ে। সেসব লাশ পাওয়া যায় বস্তবন্দী কিংবা হাত-পা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কিংবা অর্ধগলিত। নিখোঁজ হয়ে ফিরে আসার পর তারা আর মুখ খোলেনি, চিরদিনের জন্য মুখ বন্ধ। এভাবে নিখোঁজের পর লাশ হয়ে ফিরেছে এই শহরের কোমলমতি শিশু আয়াত, বর্ষা ও আয়নী। তাদের মুখও চিরদিনের জন্য বন্ধু, দেহ ছিল নিথর-বস্তাবন্দী।

আলীনা ইসলাম আয়াত (ইপিজেড)
নিহত শিশু আয়াত ছিল ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর বন্দরটিলা নয়ারহাট ওয়াজ মুন্সীর নতুন বাড়ির সোহেল রানার মেয়ে। সে স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাসা থেকে বের হয় আয়াত। তারপর বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ইপিজেড থানায় একটি জিডি করে তার পরিবার। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর নগরীর আউটার রিং রোড এলাকার আকমল আলী ঘাটের খালের অংশ থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় আয়াতের ২ পায়ের অংশ উদ্ধার করা হয়।

আয়াত হত্যায় অভিযুক্ত আবীর আলী নগরের ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা আজহারুল ইসলামের ছেলে। তাদের বাড়ি রংপুর জেলায়। শিশু আয়াতকে খুনের মামলায় তার সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর ওই বছরের ২৪ নভেম্বর রাতে তাকে গ্রেফতার করে পিবিআই।

পিবিআই’র তথ্যমতে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিশুটিকে অপহরণ করেছিল তাদেরই ভাড়াটিয়ার ছেলে আবীর। একপর্যায়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। মরদেহ গুম করতে টুকরো করা হয় এবং প্যাকেটে মুড়িয়ে সাগর ও খালের ২টি জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে হত্যাকাণ্ড ও আলামত লুকিয়ে ফেলার এমন কৌশল রপ্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে আবির।

‘আবীরের উদ্দেশ্য ছিল অপহরণ করে আয়াতের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা। এজন্য সে পরিকল্পনা করছিল। কয়েক মাস আগে রাস্তায় একটি সিম খুঁজে পায় আবীর। নতুন ফোন কিনে মুক্তিপণ দাবির জন্য সে মোবাইলে সিমটি ঢোকায়। কিন্তু, সিমটি কাজ না করায় আর মুক্তিপণ চাইতে পারেনি।’

‘সিসিটিভি ফুটেজে আবিরকে ২টি ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখা যায়। পিবিআই কর্মকর্তারা তার মায়ের বাসায় গিয়ে ব্যাগ ২টি খোঁজেন। একটি ব্যাগ পেলেও অন্যটি পাননি। তখন তাদের সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবিরকে নিয়ে পিবিআই কার্যালয়ে আনা হয়। একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আবির।’

পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, আবীর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে- সে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিতে চেয়েছিল। তার বাবা-মার মধ্যে সমস্যা আছে। আর বেকার থাকা অবস্থায় তার টাকার দরকার ছিল। সিএনজি কিনে তা দিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা ছিল তার।

মারজান হক বর্ষা (জামাল খান)
গত বছরের ২৪ অক্টোবর বিকেল ৪ ঘটিকার সময় মায়ের কাছ থেকে ২০ টাকা চেয়ে নিয়ে বাসা থেকে বের হয় বর্ষা। এরপর গলির মুখে সিকদার হোটেলের পাশের আজাদ স্টোর থেকে চিপস ও বিস্কুট কিনে বাসার উদ্দেশ্যেই গিয়েছিল সে। কিন্তু বাসায় না গিয়ে নিখোঁজ হয়ে পড়ে। এরপর তাকে খুঁজতে বের হয় বাসার লোকজন। আশপাশেসহ নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে বিষয়টি প্রথমে স্থানীয় কাউন্সিলরকে ও পরে থানায় অবহিত করা হয়। তাকে খুঁজে পেতে নগরজুড়ে মাইকিংও করা হয়।

নিখোঁজের তিনদিন পর ২৭ অক্টোবর’ সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টায় নগরীর জামালখানের সিকদার হোটেলের পিছনের একটি নালা থেকে ৭ বছর বয়সী মারজানা হক বর্ষা নামের এক শিশুর বস্তবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত বর্ষার মা বাদী হয়ে ওইদিন রাতে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। বর্ষা কুসুমকুমারী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তাদের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে হলেও জামালখান এলাকার ভাড়াবাসায় থাকতো।

যে বস্তা থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয় সেটি ছিল প্লাস্টিকের (টিসিবি) খালি বস্তা। সেই বস্তার সূত্র ধরেই খুনিকে শনাক্ত করা হয়। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর দিনগত রাত দেড়টার দিকে নগরীর জামালখান এলাকার শ্যামল স্টোর (মুদিদোকান) থেকে খুনি লক্ষ্মণ দাসকে গ্রেফতার করে পুলিশ। লক্ষ্মণ দাস চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার উত্তর পদুয়া গ্রামের মনি মিস্ত্রি বাড়ির ফেলোরাম দাসের ছেলে।

পুলিশ জানায়— শিশু বর্ষার মরদেহ যে প্লাস্টিকের বস্তায় করে ড্রেনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সেটি ছিল টিসিবির খালি বস্তা। ওই বস্তার সূত্র ধরেই খুনিকে চিহ্নিত করা হয়। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার পর প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে ড্রেনে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে আসামি।

ভুক্তভোগী বর্ষা দোকানে কিছু কিনতে এলে লক্ষ্মণ বিভিন্ন সময়ে চিপস, চকলেট দিতো। ঘটনার দিন ২৪ অক্টোবর সে ভুক্তভোগীকে একশ টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দোকানের পেছনে গোডাউনে নিয়ে যায়। সেখানে সে ভুক্তভোগীকে মুখ এবং নাক চেপে ধরে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ দেখে ভয়ে শ্বাসরোধে ওই শিশুকে হত্যা করেন। পরে গোডাউনে রাখা টিসিবির প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে মরদেহ পাশের ড্রেনে ফেলে দেয়।

আবিদা সুলতানা আয়নী (পাহাড়তলী)
সর্বশেষ ২৯ মার্চ (বুধবার) চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী কাজীর দীঘি এলাকায় নিখোঁজের আট দিনের মাথায় ১০ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নী নামে বস্তাবন্দী এক শিশুকন্যার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার (২৯ মার্চ) সকালে নগরীর পাহাড়তলী থানার আলম তারা পুকুরপাড়া মুরগি ফার্ম এলাকার একটি ডোবা থেকে লাশটি উদ্ধার করে পিবিআই।

আয়নী নগরীর পাহাড়তলী থানার কাজীর দীঘি এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকত শিশুটি। স্থানীয় একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সে। গত ২১ মার্চ বিড়ালছানা আনতে গিয়ে শিশুটি নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে পাহাড়তলী থানায় জিডি করেন। থানা-পুলিশ মামলা না নেওয়ায় শিশুটির মা বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামে মামলা করেন।

এ ঘটনায় মো. রুবেল (৩৫) নামের স্থানীয় এক তরকারি বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) মেয়েকে অপহরণের অভিযোগ এনে তার মা পোশাককর্মী বিবি ফাতেমা সবজি বিক্রেতা রুবেলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেন। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শারমিন জাহান অভিযোগ গ্রহণ করে পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিয়মিত মামলা নথিভুক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শিশু আয়নী নিখোঁজের বিষয়টি অবগত হওয়ার পর থেকে রুবেলকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। কিছু তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর মঙ্গলবার রাতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে রুবেল স্বীকার করে, মেয়েটিকে ২১ মার্চ নিখোঁজের দিনই সে কাজিরদীঘি এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ভবনের চারতলায় নিয়ে ধর্ষণ করে। এরপর শ্বাসরোধে হত্যা করে তার লাশ বস্তায় ভরে ময়লা-আবর্জনায় ভরা ডোবায় ফেলে দেয়। বুধবার ভোরের দিকে ডোবা থেকে বস্তাবন্দি প্রায় গলিত লাশটি উদ্ধার হয়েছে।

ঘটনাস্থলে আয়নীর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা ও স্বজনেরা। নৃশংসতার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া মেয়ের জন্য মায়ের আহাজারি যেন থামছিলই না! নগরবাসী এমন আহাজারির দৃশ্য দেখেছিল আয়াত, বর্ষাদের সময়ও। উপরের সব ঘটনাই প্রায় একি স্টাইলের। প্রথমে নিখোঁজ, কয়েকদিন পর মরদেহ উদ্ধার। এমন আরও অনেক নিখোঁজের খবর হয়তো মিডিয়ায় প্রকাশ হয়। নিরবে যে বস্তায় বন্দী করা সেই বস্তাও নিখোঁজ রয়ে যায়। এ নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন জাগে- তবে কি এ শহর দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে? আয়াত, বর্ষা ও আয়নীর পরের শিকার কে?

আমাদের আশেপাশে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলছে। এই শহরে একের পর এক এমন লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে, একের পর এক খালি হচ্ছে বাবা-মার বুক। কয়েকজন হয়েনার হাতে বলি হচ্ছে আমাদের শিশুগুলো। এ বিষয়ে প্রশাসকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, সচেতন হতে হবে সাথে আমাদেরও।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ