তানিয়া আবেদিন »
মা ইলিশ মাছের দাম কি খুব বেশি? ছেলের কথায় বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠে জাহানারার। গতবার ছেলে খুব বায়না ধরেছিল একটা ইলিশ মাছের জন্য। কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসারের সবদিক সামলে আর বিলাসিতা করার মতো টাকা হাতে থাকে না। নিজে মানুষের বাসায় কাজ করে, আর তার স্বামী রিকশা চালায়। তাদের মতো মানুষের জন্য ইলিশ মাছ বিলাসিতা নয়তো কি?
ছেলেকে কোনো জবাব দিতে পারল না জাহানারা। কেবল মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, মন দিয়া লেখাপড়া কর বাজান।
আর কি বা জবাব দেবে? কয়দিন পর পহেলা বৈশাখ। ইদানিং টিভিতে সব খবরেই ইলিশ মাছের খবর দেখায়। ছেলে নিশ্চয়ই দেখেছে, তাই তার ছোট মনে প্রশ্ন জেগেছে। জাহানারা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তাদের সময় তো এমন ছিল না। পহেলা বৈশাখ বলতে তারা বুঝত বাবার সাথে বৈশাখী মেলায় যাওয়া, সামর্থ্য অনুযায়ী টুকটাক খেলনা আর মুড়িমুড়কি কেনা। মা চাচীরা ঘরে কয়েকপদের সবজি মিলিয়ে কি যেন এক পদ রান্না করত। এই তো! কিন্তু এখন কি এক পান্তা ইলিশের জো উঠেছে। যেন পান্তা ইলিশ না খেলে আর পহেলা বৈশাখ হয় না।
পরদিন কাজে গেলে দেখতে পেলো বাসার স্যার এক কার্টুন ইলিশ মাছ কিনে এনেছেন। পহেলা বৈশাখের দিন বাসায় মেহমান আসবে। তাদের জন্য বিভিন্ন পদের রান্না করা হবে। সেই সাথে থাকবে নানা রকমের ভর্তা আর পান্তা ভাত। অবশ্য অন্যান্য মাছ, মুরগি-গরুর মাংসও নাকি থাকবে। জাহানারা বুঝে না মানুষ রাক্ষস নাকি! এতো খাবার কি করে খাবে?
দুই দিন ধরে বেশ উৎসব উৎসব আমেজ চলছে বাসায়। ওরা যারা সবসময় কাজ করে তারা ছাড়াও স্পেশাল আইটেমগুলো রান্না করার জন্য একজনকে ডাকা হয়েছে। সকাল থেকে তারা সকলে লেগে গেল রান্নার কাজে। সব মিলিয়ে বিশ পদ তো হবেই। ইলিশ মাছের করা হলো পাঁচ পদ। সর্ষে ইলিস, ইলিশ পোলাও, ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজা, ইলিশ ভুনা, ইলিশ মাছের ভর্তা। টেবিলে কি আর জায়গা হয় এতো আইটেমের? ডেকোরেটর থেকে আলাদা টেবিল এনে বসানো হয়েছে। সেই সাথে খাবার গুলো সাজানো হয়েছে চমৎকার করে। আবার তরিতরকারি দিয়ে কি কি সব বানিয়ে বসানো হয়েছে খাবারের উপর। জাহানারা অবাক হয়। আজকাল তরকারির এতো দাম! পহেলা বৈশাখের জন্য গত কয়দিনে দাম আরো বেড়েছে। সেখানে মানুষ এতো টাকার তরকারি কিনে এভাবে নষ্ট করে!
মেহমান এলো, খাওয়া দাওয়া করে চলেও গেলো। এবার এলো সব গুছানোর পালা। মেহমানদের খাবারের প্লেটগুলো আনতে গিয়ে জাহানারা লক্ষ্য করল খুব কম প্লেট আছে যেখানে কোনো খাবার নেই। বেশিরভাগ প্লেটেই খাবার রয়ে গেছে। এই জিনিসটাও জাহানারার মাথায় আসে না। খেতে পারবে না জেনে মানুষ কেন নেয়? অযথা খাবার নষ্ট করে। কত মানুষ খেতে পায় না! আর যারা এই আয়োজন করেছে খাবারগুলো থেকে গেলে তারাও তো পরে খেতে পারে। অথবা কাউকে দিয়ে দিতে পারে।
প্লেটগুলো গুছাতে গিয়ে দেখল কয়েকটা প্লেটে আস্ত ইলিশ মাছের টুকরো রয়ে গেছে। মনে হয় বাচ্চাদের কারো প্লেট হবে। রান্না ঘরে প্লেটগুলো রেখে সে অনেকক্ষণ মাছের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। বারবার ছেলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। সাতপাঁচ না ভেবে জাহানারা ইলিশ মাছের টুকরোগুলো উঠিয়ে একটা প্যাকেটে ভরে নিল। যদিও মনের মধ্যে একটু খচখচ করছিল। একজনের এটো প্লেটের মাছ এভাবে ছেলেকে খেতে দিবে? আবার পরক্ষণে ভাবল নিজেরাই তো একজনের পাত থেকে তুলে আরেকজনকে প্রায় খেতে দেয় তাতে কি খাবার নষ্ট হয়ে যায়? এছাড়া মাছের পিসগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলো ধরা হয়নি। তাছাড়া এই মাছ গুলো ফেলে দিবে ওরা। তার চেয়ে বরং সে নিয়ে নিয়েছে ছেলের জন্য। অন্তত নষ্ট তো হবে না।
আজ তার মনে এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করছে। ছেলেটা গত এক বছর ধরে ইলিশ মাছের কথা বলছে। কিন্তু অভাবের সংসারে ছেলের এই আবদার মিটাতে পারেনি। আজ ছেলেকে এই দুই পিস মাছ খেতে দিবে। ছেলে তৃপ্তি সহকারে খাবে আর সে চেয়ে চেয়ে দেখবে। এটা মনে করতেই দুচোখ ভিজে এলো। চোখ মুছে বাকি কাজগুলো শেষ করে, মাছের প্যাকেটটা নিয়ে বের হতে যাবে তখন বাসার ম্যাডামের সাথে দেখা। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জাহানারা তোমার হাতে কি? জাহানারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। তাকে চুপ দেখে ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করেন, কি হলো কিছু বলছ না কেন? হাতের প্যাকেটটায় কি?
এবারও জাহানারা কিছু বলতে পারে না কেবল নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে। ম্যাডাম ওর হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খুলে দেখে বললেন, এসব কি জাহানারা? তুমি কিনা শেষে চুরি শুরু করলে? অথচ তোমাকে আমি কি পরিমান বিশ্বাস করেছি!
জাহানারা লজ্জায় মিইয়ে গেলো। ম্যাডাম এসব কি বলছেন? এতদিনে তাকে এই চিনেছেন ম্যাডাম? জাহানারা কিছু বলতে যাবে তার আগে ম্যাডাম বলে দিলেন, কাল থেকে তোমার আর কাজে আসতে হবে না। আমি কোনো চোরকে আমার ঘরে জায়গা দিব না।
বাইরে বের হয়ে লক্ষ্য করল তার মন বিষিয়ে রয়েছে। কি হয়েছিল তখন তার? সে কোন জবাব দিতে পারল না কেন? সে তো অন্যায় কিছু করেনি। ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে কিন্তু সেই বাতাসকেও জাহানারার কাছে ভারী মনে হচ্ছে। এতক্ষণ তার মাঝে যে উত্তেজনা কাজ করেছে সে জায়গায় এখন ভর করেছে গ্লানি। তার কথা না শুনেই ম্যাডাম তার গায়ে চোরের খেতাব লাগিয়ে দিলেন। খুব গা জ্বালা করতে লাগল। এতো মানুষকে দাওয়াত করে এতো আইটেম রান্না করে খাওয়াল অথচ তারা কাজের সহকারিরা ঠিক মতো খেয়েছে কিনা একবার খবরও নিল না। বিশ পদ তো দূরের কথা তাদের পাতে তিনপদও জুটেনি ভালো করে। তারা কাজ করে ঠিক আছে, কিন্তু এই বিশেষ দিনে কি তারাও একবেলা অতিথিদের মতো খাবার খাওয়ার আশা করতে পারে না?
প্যাকেট ধরে থাকা হাতটাকে ভীষণ ভারী মনে হচ্ছিল। কিছুদূর এগুতেই একটা ডাস্টবিন দেখতে পেলো। তার পাশেই কয়েকটা ক্ষুধার্ত কুকুর শুয়ে আছে। প্যাকেটটা কুকুরগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিতেই মনের অজান্তেই মুখ থেকে থু শব্দটা বের হয়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ রকম নির্ভার লাগতে লাগল জাহানারার।
লেখক : গল্পকার