৫ নভেম্বর ২০২৫

বালিয়াড়িতেই দাফন সেই মৃত তিমির

কক্সবাজার প্রতিনিধি »

কক্সবাজার সৈকত তীরের জলে প্রায় ১৪ ঘন্টা ভাসার পর মাঝরাতে কলাতলীর সায়মন বিচ হোটেলের সামনে দক্ষিণাংশে বালিয়াড়িতে উঠে আসে সেই মৃত বিশালাকায় তিমির দাফন সম্পন্ন হয়েছে। যেখানে আটকা পড়েছিল, সেই স্থানের পাশেই তাকে বাতি খুড়ে পুতে ফেলা হয়।

বুধবার (১৯ এপ্রিল) ভোররাত তিনটা নাগাদ তার দাফন কাজ সম্পন্ন হয় বলে জানান কক্সবাজার জেলা প্রশাসনে পর্যটন সেলের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহ।

এর আগে মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সকাল থেকে জোয়ার-ভাটায় ভেসে সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের রামুর সৈকতের দরিয়ানগর পয়েন্ট থেকে রেজুরব্রীজ পর্যন্ত আসা-যাওয়া করা মৃত তিমিটি রাতের ভাটায় তীরে উঠে আসে বলে জানান কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের কক্সবাজার (সদর) রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা।

তিনি জানান, সাগরে ভাসমান তিমিটির বিষয়ে মঙ্গলবার সকাল হতেই খোঁজ নিয়ে নজর রাখছিলেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহ। রাতে তিমিটি বালিয়াড়িতে উঠে আসার খবর পেয়েই তিনি (নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট) কক্সবাজার পৌরসভা, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা নিয়ে মাটিতে পুতে ফেলার উদ্যোগ নেন।

মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত অবধি কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ এলাকার সাগরে পানিতে মৃত তিমির দেহটি ভাসতে দেখে স্থানীয়রা। অবশেষে রাত্রে আনুমানিক ১০ ঘটার দিকে কলাতলীর সাইমন বিচ এলাকার বালিয়াড়িতে আটকা পড়ে। খবর পেয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বুরি) একটি বিশেষজ্ঞ দল রাত ১২ টার দিকে ঘটমাস্থ এসে ময়নাতদন্তের জন্য নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করেন।

পর্যটন সেলের ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুম বিল্লাহ জানান, মৃত তিমিটি দৈর্ঘ্য মিনিমাম ৫০ ফুট। এটির সারা শরীর সাগরে মাছ ধরতে বসা জালে মোড়ানো। ধারণা করা হচ্ছে জালে আটকে পড়ার পর জেলেদের আক্রমণের শিকার হয়ে তিমিটি মারা গেছে। বেশ কিছুদিন আগে মরা যাওয়ায় পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দুর্গন্ধে সায়মন বিচ এলাকায় দাঁড়ানোও কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠে। দুর্গন্ধের দূর্ভোগ থেকে পরিবেশ রক্ষায় পৌরসভার সহযোগিতায় স্কেভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র-ভকু) ব্যবস্থা করে প্রশাসনের সকল বিভাগের সমন্বয়ে তিমির মরদেহটি আটকে পড়া স্থানের পাশেই রাত তিনটা নাগাদ বালি চাপা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর জানান, এরআগে ২০২১ সালের ৯ ০ ১০ এপ্রিল সৈকতের হিমছড়ি পয়েন্টে দুটি মৃত তিমি ভেসে এসেছিল, যে তিমিগুলো ছিল ব্রাইড’স প্রজাতির। মঙ্গলবার ভেসে আসা তিমিও একই প্রজাতির।

তিমিটি অন্তত এক সপ্তাহ আগেই মারা গেছে বলে মনে করেন বোরি’র সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তিমিটির শরীরে বিভিন্ন অংশে পঁচন ধরায় দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মৃত তিমিটির শরীরে জাল ও বয়া পেঁছানো রয়েছে। মাথায় রয়েছে আঘাতের চিহ্নও। সাধারণত মৎস্য শিকারীদের জালে আটকা পড়ে, জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে কিংবা সমুদ্র দুষণের কারণে পরষ্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ও দিকভ্রান্ত হয়ে উপকূলের অগভীর জলে এসে আটকা পড়ে মারা যায় তিমি।

বিজ্ঞাীি তরিকুল জানান, এ তিমিটি ‘ব্রাইড’স হোয়েল’ বা বলিন তিমি হিসাবে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম বলিনোপেট্রা ইডেনি। এ প্রজাতির তিমির দাঁত নেই। এরা মুখের মধ্যে চিরুনির মতো একটি অংশ দিয়ে খাবার প্রক্রিয়াজাত করে।

উল্লেখ্য, কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে প্রায়শ: নানা সামুদ্রিক প্রাণির মৃতদেহ এবং জৈব-অজৈব বর্জ্য ভেসে আসে। আর গত তিনমাসে ভেসে আসে শত শত মরা রাজকাঁকড়া, জেলিফিশ, কচ্ছপ ও ডলফিনসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণি।

সাগরে তিমি ও তিমি জাতীয় প্রাণিদের বিশাল পরিবেশগত সেবার কারণে পরিবেশ বিজ্ঞানে এদেরকে ইকোসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার্স বা বাস্তুসংস্থান প্রকৌশলী বলা হয়। তিমিরা তাদের স্বভাবজাত বা আচরণগত প্রকৌশলের মাধ্যমে শুধু নিজেদের বসবাসের পরিবেশ ঠিক রাখেনা, অন্য প্রাণিদের জন্যও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়। যে কারণে তিমিরা যে পরিবেশে বসবাস করে সেই পরিবেশকে ধরা হয় একটি উর্বর, জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ নির্মল পরিবেশ হিসাবে।

বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তার ৯০ শতাংশই কমায় সমুদ্রে থাকা ফাইটোপ্লাংক্টন; যা এক ধরনের ক্ষুদ্র সবুজ উদ্ভিদ। এরা প্রতি বছর ২বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ কমায়। ফাইটোপ্লাংক্টন সামুদ্রিক প্রাণিদের জন্যও একটি পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ ফাইটোপ্লাংক্টন সমুদ্রের উপরি স্তরে তাদের জীবনচক্র শেষ করার পর তাদের দেহাবশেষ সাগরের তলদেশে গিয়ে জমা হয়। আর তিমিরা সাগরের তলদেশে জমাকৃত এই অব্যবহৃত পুষ্টিকে পুনরায় উপরিস্তরে নিয়ে এসে সামুদ্রিক প্রাণিদের জন্য খাদ্য যোগান তৈরি করে। তিমিদের এই কার্যক্রম হুয়েল পাম্পিং নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ