৭ নভেম্বর ২০২৫

৩২ বছর পরও হারানো মা-বাবা, ভাই-বোনের স্মৃতি হাতড়ান ফরিদ

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

‘১৯৯১ সালের ২০ এপ্রিল, মামাত ভাইয়ের সাথে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে নানাবাড়ি বেড়াতে যায়। আবছা মনে পড়ে, মা আমায় গুছিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা বাণিজ্যিক কারণে গোমাতলীতে থাকায় তাকে বলে যেতে পারিনি। নানাবাড়ি যাবার ৫-৬দিন পর শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এ বৃষ্টির সূত্র ধরেই বাংলাদেশের উপকূলে ২৯ এপ্রিল রাতে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়। পরেরদিন মা ও ছোট ভাই-বোনদের জন্য মন কাঁদায় ফিরে আসি ঈদগড়ের বাসায়। পৌঁছে দেখি ঘরে কেউ নেই। খবর পায়, আমি নানাবাড়ি যাবার পর বাবা এসে মা ও অন্যদের গোমাতলীতে চিংড়ি ঘের করতে নিয়ে গেছেন। তারা অবস্থান নিয়েছিলেন মহেশখালী নদীর গোমাতলী তীরের জলিল সিকদারের ঘের পাড়ের বাসায়। জলোচ্ছ্বাসের স্রোত ঘরসহ সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এলাকায় বেঁচে যাওয়া স্বজনরা সবাই মিলে খোঁজ করে মরদেহও পায়নি। এনালগ যুগ, তার উপর খেটে খাওয়া পরিবার হওয়ায় কোন ছবি তোলা ছিল না- তাই ধীর ধীরে বাবা-মা ও নিখোঁজ ভাই-বোনের অবয়ব ভুলে গেছি। ৩২ বছরে এলাকায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা, ভাই-বোন বিস্মৃতি হওয়ার স্মৃতি আমাকে পিছু ছাড়েনা কখনো। ২৯ এপ্রিল এলে তাদের কথা বেশি মনে পড়ে।’

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার (সাবেক সদর উপজেলা) উত্তর গোমাতলীর বাসিন্দা বর্তমানে কক্সবাজার পৌরসভায় বাস করা বেসরকারি কর্মজীবী ফরিদুল আলম (৩৯) কক্সবাজার রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে বসে শুক্রবার রাতে ভয়াল ২৯ এপ্রিলে স্বজন হারানোর সেই স্মৃতি বলতে গিয়ে আবেগ আফ্লুত হন। সেদিনের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে দুই থেকে ৬ বছর বয়সী দুই ভাই, দুই বোন, বাবা-মাসহ স্বজন ও ঘর বাড়ি হারিয়েছিলেন তিনি।

শুধু তিনি নন, উপকূলের শত শত মানুষ তার মতো আপনজনকে হারিয়ে এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। তিন দশক পিছনে ফেলে এসেছেন তারা। কিন্তু হারানোর বেদনা তাদের কখনো নিস্তার দেয় না। উপকুলবাসীর স্বজন হারানোর সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। এদিনে ভারাক্রান্ত মনে উপকূলবাসি তাদের হারানো স্বজনদের স্মরণ করছে। কেউ মিলাদ পড়িয়ে, দরিদ্র মানুষদের মাঝে খাবার বিতরণ করে কিংবা বিলাপে শান্তনা খুঁজার চেষ্টা চালান বলে উল্লেখ করেন ফরিদ।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফরিদ বলেন, বাবা শামশুল আলম রামু উপজেলার ঈদগড় ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন মেম্বার ছিলেন। তবে, সেখানে তিনি থাকতেন কম। গ্রীষ্মে লবণ ও বর্ষায় চিংড়ি চাষে আয় ভালো হওয়ায় কক্সবাজার সদরের পোকখালীর গোমাতলী বাবার নানাবাড়ি এলাকায় থাকতেন তিনি। গোমাতলী মোহাজের উপনিবেশ ভূমিহীন সমিতির নামে লিজ নেয়া জমিতে অন্যদের মতো চাষাবাদ করতো। মা নুর জাহান বেগম আমাদের নিয়ে ঈদগড়-গোমাতলী আসা-যাওয়ায় থাকতেন। ১৯৯১ সালে আমার বয়স ৮-৯ বছর হবে। আমার ছোট দুই ভাই-দুই বোন ছিল মনে আছে। তাদের নাম-চেহারা কিছুই মনে নেই।

ফরিদ আরো বলেন, স্বজনদের কাছ থেকে শুনি- দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম- স্কুল ফাঁকি দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। ঘূর্ণিঝড়ের আগে সুযোগ পেয়ে নানাবাড়ি বেড়াতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ফিরে এসে যে মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনদের আর দেখতে পাবো না ঘূর্ণাক্ষরে জানলেও তাদের ছেড়ে যেতাম না। আমার বড় ভাই জিয়াউর রহমান বাবা-মায়ের সাথে না থেকে পাড়ার এক দোকানে অবস্থান করায় ভেসে যাওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। বাবা-মাকেও নাকি বেড়িবাঁধের ঘর থেকে চলে আসতে বলেছিলেন স্বজনরা। মৃত্যুর পয়গাম আসায় তারা হয়তো পাড়ায় ফিরেনি।

ফরিদ জানান, এতিম হিসেবে বায়তুশ শরফে থাকার সুযোগ পেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করার তৌফিক পেয়েছি। ২০১২ সালে নিকটাত্মীয় আসমাউল হোসনাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে দাম্পত্য জীবনে মুদ্দাসির রহমান (৭) ও মোবাস্সির রহমানকে (সদ্যজাত) নিয়ে বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করে সুখেই কাটছে দিন। ব্যস্ততায় সময় কাটে, কিন্তু ৩২ বছর আগের সেই স্মৃতি আমায় ছাড়ে না। বাবা-মা, ভাই-বোন কারো অবয়ব মনে নেই, কিন্তু তাদের শূন্যতা বুকে চিন চিন ব্যাথার জন্মদেয়। তবে, আজকের জন্য প্রতীক্ষা নয়, প্রতিদিন প্রতিবেলা নামাজে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও সেদিন হারানো স্বজন, উপকূলবাসীর জন্য ইছালে সওয়াব পাঠানো হয়।

ফরিদ বলেন, ৩২ বছরে এলাকার যাতায়াত-যোগাযোগ অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে অনেক। এলাকায় এলাকায় উঠেছে বহুতল সাইক্লোন শেল্টার। এখন ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে গভীর রাতেও নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়া যায়। ১৯৯১ সালে যেটি ছিল দুরূহ। তবে, আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ভালো হলেও গোমাতলীর চারপাশের বেড়িবাঁধ ১৯৯১ সালের মতোই নাজুক, জোড়াতালি দিয়ে মেরামত চলে আসছে। এখনো অমানিশা-পূর্ণিমার জোয়ার কিংবা কোন দূর্যোগে সাগরে পানি বাড়লে এলাকা এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকার খবর প্রচার হয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের এই দিনে স্মরণকালের সেই ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস চট্টগ্রাম কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা তছনছ করে এক মহাধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। রাতের অন্ধকারে কয়েক ঘন্টায় লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেইদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই রুদ্ধরোষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি উপকুলের মানুষ আগে কখনও হয়নি। তাই ২৯ এপ্রিল এলে স্বজনহারা মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয় উপকূলের আকাশ-বাতাস। সেই জলোচ্ছ্বাসের কবলে স্বজন হারানোর বেদনা আজও অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তুলে।

তথ্যানুসন্ধান উঠে এসেছে, ১৫৬১ সালের জ্বলোচ্ছ্বাসে উপকূলের বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ১৭৬২ সালে, ১৭৯৫ সালের ৩ জুন, ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবরে, ১৯০৫ সালের ২৯ এপ্রিলে, ১৯৬৩ সালের ২৭ মে, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়াদ্বীপসহ উপকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ জ্বলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়ায় খুদিয়ার টেক নামক একটি এলাকা বিলীন হয়ে গেছে।

১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপকূলে স্থাপিত হয় ৫ শতাধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। যার মধ্যে অনেকগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালী, পেকুয়া, সদর উপজেলা এলাকা এবং টেকনাফ‘র বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছিল। ওই ভাঙা বাঁধ এখনো পরিপূর্ণ মেরামত হয়নি। ফলে উপকুলের লাখো মানুষ এখনো ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন। তাই সংকেত দেখা দিলেই নিরাপদে ছুটতে হয় তাদের। উপকূলবাসীর দাবি, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার করে যেন টেকসই করা হয়।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ