বর্ষা যেন জনজীবনে বয়ে আনে প্রশান্তির ছোঁয়া। সেই বর্ষায় একশ্রেণীর মানুষের মনে ভর করে প্রাণনাশের আতঙ্ক। যেখানে রাত হলে সবাই নিশ্চিতে ঘুমাতে যায় সেখানে চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত মানুষের বিবরণ কিছুটা ভিন্ন। রাতে ঘুমাতে গেলে মনের মাঝে ভয় কাজ করে, এই বুঝি পাহাড় ধসে মাটিতে সব মিশিয়ে দিলো।
প্রতি বছর বর্ষা এলেই শুরু হয় সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার তোড়জোড় । চালানো হয় ভাঙচুর, উচ্ছেদ অভিযান। পাহাড় ধসে মৃত্যু ঝুঁকি এড়াতে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র। তবে এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে নেই স্থায়ী কোনো সমাধানের কার্যক্রম। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না হওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই এখানে থাকছেন বলে জানান এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দারা।
প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে অহরহ। যা পুরো দেশের তুলনায় চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক তথ্য অনুযায়ী, পাহাড় ধসে গত ১৬ বছর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৪৮ জনের প্রাণ ঝরেছে।
চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন প্রায় এক হাজারের বেশি পরিবার। বর্ষা এলেই তাদের বসতিতে চলে উচ্ছেদ। এদিকে স্থায়ী কোন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছরই পরিবার পরিজন নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এসব ছিন্নমূল বাসিন্দানের।
চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপকমিটির তথ্যমতে, নগরের ২৫টি পাহাড়ে ১ হাজারেরও বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এর মধ্যে ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার বসবাস করে।
বছরের পর বছর এই এলাকায় যারা বসবাস করছেন তাদের অনেকেই অস্থায়ীভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন এখানে। বসবাসকারী অনেকেই সঠিক কাগজপত্রের অভাবে বানাতে পারছেন না জাতীয় পরিচয় পত্র। এছাড়াও পাসপোর্টের জন্য আবেদনের পর পরিদর্শনে আসলে স্থায়ী বসবাসকারী না হওয়ায় পাসপোর্ট বানাতে পারছেন তা এখানকার ছিন্নমূল বাসিন্দারা। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসের নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে স্থায়ী পুনর্বাসনের দাবি জানান এখানকার বাসিন্দারা।
লালখান বাজার মতিঝর্না এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, ঝুঁকি থাকলেও খরচ কমানোর জন্য এখানে থাকি। আমার ঘর ভাড়া ৩৫০০ টাকা তবে এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে গেলে খরচ বেড়ে সাত থেকে আট হাজারে দাঁড়াবে। সরকারীভাবে আমাদের যদি কোন নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের ঝুঁকিটা দূর হতো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাকা-সেমিপাকা ঘরে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। ওই সকল ঘরে নেই কোনো সরকারি বৈদ্যুতিক সংযোগ। এছাড়াও নেই পানি ও গ্যাসের সুবিধা। এরপরেও ঘরগুলোতে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন করে কষ্টেশিষ্টে দিন পার করছেন মতিঝর্ণা এলাকায় বসবাসরত সাধারণ জনগণ।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এলাকায় বসবাসকারী প্রায় সকলেই নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ গার্মেন্টস শ্রমিক কেউবা আবার দিন মজুর। বাদ নেই রিকশা চালক, সিএনজি চালক থেকে শুরু করে অন্যান্য নিম্ন আয়ের পেশাজীবী মানুষ। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও বছরের পর বছর এখানে থাকতে থাকতে এটাই আজ তাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
১৪ নং লালখান বাজার ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল মুঠোফোনে বাংলাধারাকে বলেন, লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকা পাহাড় ধসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছরই আমরা বর্ষার মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করি। এবছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এর কোনো স্থায়ী সমাধানের পদক্ষেপ কিংবা পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেছেন কিনা তা জানতে চাইলে সেই প্রশ্নের জবাবে জনপ্রতিনিধি আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল বলেন, সিটি করপোরেশনের এক মতবিনিময় সভায় আমি আমাদের জেলাপ্রশাসকের কাছে প্রস্তাবনা রেখেছিলাম যাতে এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। আমার এলাকায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ একর জায়গা বেদখল আছে। এখান থেকে ১৫ থেকে ২০ একর জায়গা পুনর্বাসনের জন্য ব্যবহার করা হলে এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দারা অনেক বেশি উপকৃত হতো।
তিনি আরও বলেন, এলাকায় এক একটা পরিবার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর যাবত বসবাস করছে। আমরা একবার তাদের উচ্ছেদ করতে গিয়েছিলাম, তখন একজন বললো, আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দিলে কোথায় যাব আমরা? এই প্রশ্নের জবাবে তখন কিছুই বলতে পারিনি আমি। তাদের কোনোভাবেই উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত।













