কাঠের কাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোটখাট একটি দোকান। ওপর থেকে দুটো আবছা বাতি ঝুলছে। বাতির নিচে চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ। সামনের দিকে ঝুলছে কিছু প্যাকেট। এসবে রাখা বিস্কুট, বনরুটিসহ আরও নানা পদের বেকারি পণ্য।
চট্টগ্রাম নগরের ওলিগলিতে অস্থায়ী এসব দোকান দেখা যায় হরহামেশাই। ‘টং’ নামে পরিচিত এসব দোকানেই কাটে তরুণ ও মাঝ বয়সীদের দিনের একটি অংশ। ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময়ের ছুটি নিয়ে বন্ধু-বান্ধব মিলে চায়ের কাপে আড্ডা জমে এসব টং-এ।
টং দোকানে শ্রেণি-ভেদাভেদ নেই। স্বল্প আয় থেকে মধ্যম আয়ের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ ‘মামা চা দিয়েন’ বলে বসে পড়েন দোকানে সামনে পাতা বেঞ্চে কিংবা দাঁড়িয়ে যান দোকানের সামনে। তবে মানুষের ভিড় আগের মতো হলেও বসার স্থায়িত্ব আগের তুলনায় কমেছে। কারণ আগের তুলনায় খরচ বেড়েছে এসব টং-এর আড্ডায়।
চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় অর্ধশতাধিক টংয়ের মধ্যে একটি আকরামের টং। গতকাল সন্ধ্যায় আকরামের সঙ্গে কথা হয়। তখনও চামচ হাতে এককাপ চায়ে চিনি মেশাচ্ছিল সে।
আকরাম জানায়, গত তিন বছরে চায়ের দাম ৫ টাকা থেকে ১২ টাকা হয়েছে। কিছু দোকানে ১৫ টাকাও বিক্রি হয় প্রতিকাপ চা। এর মূল কারণ দুধ-চিনির দাম বৃদ্ধি। আগে একজন ব্যক্তিই দুই-তিন কাপ চা পান করত। এখন এক কাপ চা দুই জন ভাগ করে নেয় অধিকাংশ সময়। কারণ ১৫ টাকা দিয়ে এক কাপ চায়ের স্বাদ নেওয়া সব ক্রেতার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
দাম বেড়েছে উপকরণের
চায়ের মূল উপাদান চা পাতা, দুধ ও চিনি। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি খোলা চা পাতার দাম ৪৮০ টাকা, প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, কন্ডেন্সড মিল্ক (৪০০ গ্রাম) ১১০ থেকে ১২০ টাকা ও ব্র্যান্ড ভেদে বিভিন্ন গুড়া দুধের দাম প্রতি কেজি ৭৬০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত।
ঠিক এক বছর আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৫ থেকে ৮৫, চা পাতা, কন্ডেন্সড মিল্ক ৪৫ থেকে ৫০ ও গুড়া দুধ ৬৭০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। অর্থাৎ এক বছরেই উপকরণ ভেদে দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ।
আগ্রাবাদসহ নগরের বহদ্দারহাট, ওয়াসা মোড, টাইগার পাস, চকবাজার, প্রবর্তক এলাকার দোকানিরা বলেন, চায়ের মূল উপাদানের দাম বাড়ার কারণে কাপ প্রতি চায়ের দামও বাড়াতে হয়েছে। প্রায়ই ক্রেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু খরচ সামাল দিতে বাধ্য হয়ে দাম বাড়াতে হয়।
প্রবর্তক এলাকার একটি টংয়ে কথা হয় বেসরকারি কর্মকর্তা ফাহাদ হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি প্রায় চার বছর ধরে এই এলাকার বাসিন্দা। চার বছর আগে চা প্রতি কাপ ছিল ৫ থেকে ৬ টাকা। বর্তমানে ১০ থেকে ১২টাকার নিচে চা পাওয়া দুষ্কর।
বেড়েছে অন্যান্য অনুষঙ্গের দামও
এ ছাড়া প্রতিটি টংয়ে বিভিন্ন বেকারি পণ্যগুলোর দামও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেকখানি। বেকারি পণ্যগুলোতে প্রধান উপকরণ ময়দা, আটা ও চিনি। এসকল উপকরণের দামের প্রভাব পড়েছে বেকারি পণ্যের ওপর।
বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা ময়দা ৬০ থেকে ৬৫ ও খোলা আটা প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে প্রতি কেজি ময়দা ছিল ৫৫ থেকে ৫৮ ও আটার দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৪ টাকা।
খরচ আরও বাড়ছে
আগ্রাবাদ এলাকায় কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মো. আরিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথম বর্ষে থাকাকালীন প্রতি কাপ কন্ডেন্সড মিল্কের চা ছিল ৫ থেকে ৬ টাকা। আর বিভিন্ন প্রকারের বনরুটিগুলো ছিল একই দামে। বর্তমানে তিনি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রতি কাপ চায়ের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা। আর বনরুটির খরচও প্রায় একই।
এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিত্যপণ্য চিনির দাম বাড়ছে। পাশাপাশি সব পণ্যের দামই উর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় টংয়ের আড্ডায় খরচ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা সাধারণ ভোক্তাদের।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও চায়ের কাপে আলোচনা থেমে নেই এসব টং দোকানে। এক কাপ চা দুজন মিলে হয়তো নিচ্ছেন ক্রেতারা। তবুও একবার হলেও আসেন টংয়ের আড্ডায়।
ভবিষ্যতেও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়েই হয়তো আলোচনা করে যাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘মামা চা বানাও’ ধ্বনি আরও বাড়তে থাকবে। আর আকরামদের মতো দোকানিরা হয়তো চামচ হাতেই বানিয়ে যাবে কয়েক শ কাপ চা।












