৩০ অক্টোবর ২০২৫

ককটেল-বিস্ফোরক-সামরিক পোশাক-বোমা তৈরীর সরঞ্জাম জব্দ

আরসা’র লজিস্টিক শাখার প্রধানসহ গ্রেফতার ৩

কক্সবাজার সদরের পৌরসভাস্থ কলাতলীর ডিসি পাহাড় সংলগ্ন আদর্শগ্রাম থেকে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা’র লজিস্টিক শাখার প্রধান হাফেজ রহমত উল্লাহসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১৫’র সদস্যরা। এসময় বিপুল পরিমাণ ককটেল, বিস্ফোরক সদৃশ বস্তু, সামরিক বাহিনীর ন্যায় পোশাক ও বোমা তৈরীর সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।

রবিবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার ও এসব সরঞ্জাম জব্দ করা হয় বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-১৫’র সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ এন্ড মিডিয়া) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৩, ব্লক-এ/০২ এর বাসিন্দা মৃত আবুল কাশেমের ছেলে হাফেজ রহমত উল্লাহ (৩৫), কুতুপালং ক্যাম্প-৫, ব্লক-ই/৬’র বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলামের ছেলে মঞ্জুর আলম (২৩) ও একই ক্যাম্পের কামাল হোসেনের ছেলে নুরুল ইসলাম।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী জানান, রাষ্ট্রীয় বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-১৫’র সদস্যরা জানতে পারে-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা’র লজিস্টিক কমান্ডার ও তার কয়েকজন সাথী কক্সবাজারের কলাতলী এলাকার ডিসি পাহাড় সংলগ্ন আদর্শগ্রামে অবস্থান করছে। এ তথ্যের প্রেক্ষিতে রবিবার ভোরে ওই এলাকায় গিয়ে আভিযানিক দল একটি বাড়ি ঘেরাও করে। পরে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে সকাল ৯টার দিকে আরসা’র লজিস্টিক শাখার প্রধান হাফেজ রহমত উল্লাহসহ আরসার তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

তিনি আরো জানান, এসময় ৪ কেজি ৯ গ্রাম বিস্ফোরক দ্রব্য, ১৫ পিস ককটেল, আইডি তৈরীর সরঞ্জাম, দেড় কেজি মারকারী, একটি ওয়াকিটকি, ৫৩টি সার্কিট, ৯ বান্ডিল সামরিক বাহিনীর ন্যায় পোষাক তৈরীর কাপড়, ৭০টি গেঞ্জি, ১২টি টুপি, ১৩০টি হ্যান্ড গ্লোভস, নগদ আড়াই হাজার টাকা, ২টি মোবাইল এবং একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত হাফেজ রহমত উল্লাহ ২০০০ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপে বসবাস এবং সেখানে থাকাকালীন সময়ে হেফজ শেষ করে। এরপর নানা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মেয়াদে হাফেজ, দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়াশুনা করে এবং বার্মিজ, রোহিঙ্গা, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবী ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠে। পড়াশুনা শেষে সে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার গিয়ে নিজ জমি-জমা বিক্রি করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া যায়। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে চলে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাস শুরু করে। ২০১৯ সালে আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার মাষ্টার ইউনুছের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মৌলভী রফিকের মাধ্যমে হাফেজ রহমত উল্লাহ আরসায় যোগ দেন। আরসায় যোগদানের পরপরই তাকে মিয়ানমারে তসকিলে (ট্রেনিং) পাঠানো হয় এবং সেখানে ৪ মাস অবস্থান করে আরসার হয়ে ট্রেনিং সম্পন্ন করে।

আরো জানায়, প্রথমে তিনি আরসার ওলামা বডির সদস্য হয় এবং বিভিন্ন মসজিদে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আরসায় যোগদানের দাওয়াত দিতো। পরে আরসার ওলামা বডির সদস্যদের দাওয়াতি ট্রেনিং দিতে গিয়ে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওস্তাদ খালেদের সাথে সুসম্পর্ক হয়। সিগনাল এপ্সের মাধ্যমে হাফেজ রহমত উল্লাহ তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সংগ্রহ এবং সরবরাহ করার সুবিধার্থে ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে কক্সবাজার শহরে ভাড়া বাসা নিয়ে বসবাস করছিল। এ সুবাদে আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ এবং লজিষ্টিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান।

হাফেজ রহমত উল্লাহর বরাতে র্যাব আরো জানায়, আরসা এবং সামরিক শাখার প্রধানের ডিমান্ড অনুয়ায়ী বিভিন্ন উৎস হতে আরসা সদস্যদের জন্য ইউনিফরমের কাপড়, শীত বস্ত্র, রেইন কোট, বুট জুতা, মোজা, বেল্ট, ক্যাপ, ব্যাগ এবং বোমা ও মাইন বানানোর জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মারকারী (পারদ), ফোম, টর্চ লাইট, ব্যাটারী, ব্যাটারীর ক্যাপ, ইলেকট্রিক তার, ইলেকট্রিক ক্লিপ, ছোট টেবিল ঘড়ি, ছোট লাইট, লোহার রড, সিমেন্ট, ছোট লোহা, পাইপ, কাচঁ সহকারে নানান ধরনের বোমা ও মাইন তৈরীর সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে তা জমা রাখতো। পরবর্তীতে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড খালেদের নির্দেশনায় সরঞ্জামাদি উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা’র সদস্যদের কাছে পাঠাতো।

গ্রেফতারকৃত মঞ্জুর আলম ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসে সপরিবারে ক্যাম্পে বাস শুরু করে। ২০১৯ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পের নাইট গার্ড হিসেবে কাজ করতো। ২০২১ সালের শেষের দিকে আরসা নেতা ইমাম হোসেনের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করে আরসার ব্লক জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি ১০ জনের দলনেতা।

নুরুল ইসলামও ২০১৭ সালে টেকনাফের শামলাপুর হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে সপরিবারে বাস শুরু করে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে ৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক-বি/৪ এর আরসার ব্লক জিম্মাদার জলিলের মাধ্যমে আরসায় যোগ দেন এবং ক্যাম্প-৫ এর বি ব্লকের আরসার ব্লক পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো। তারা আরসার সিনিয়র কমান্ডাররা এক স্থান হতে অন্য স্থানে গমন কালে রাস্তা, দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতো। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ আরসা বিরোধী সংগঠনের সদস্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করতো। দায়িত্ব পালনকালে তারা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করতো। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করে কক্সবাজার সদর থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। বলে উল্লেখ করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সালাম চৌধুরী।

উল্লেখ্য, চলমান সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্ক আরসা’র সন্ত্রাসীগোষ্ঠি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে আরসা’র সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে প্রচার পায়। ক্যাম্পে অপরাধ দমনে সার্বক্ষনিক মনিটরিং’সহ র‌্যাব-১৫ পুরোবছর কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান গ্রুপ কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী ও অর্থ সমন্বয়ক মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান, ক্যাম্প কমান্ডার, ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান, স্লীপার সেল ও ওলামা বডির অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার, অর্থ সমন্বয়ক, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডারসহ এপর্যন্ত ৮৩ জন আরসা’র সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতারপূর্বক আদালতে সোপর্দ করেছে, এ ধারা অব্যহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন র‌্যাব-১৫’র অধিনায়ক লে. কর্ণেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন।

আরও পড়ুন