২০১৯ ও ২০২০ সালে হাটহাজারী উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমীন ব্যক্তিগত খরচে বিভিন্ন স্কুল ও সড়কের পাশে ৩০ হাজার বৃক্ষরোপন করেন; যা সে সময় দেশ জুড়ে প্রশংসিত হয়। পরে ২০২১ সালে এই দম্পতিকে বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার-২০২২ এর জন্য মনোনীত করা হলেও পরে তাদের বাদ দিয়ে এ পদক দেওয়া হয় হাটহাজারী উপজেলা পরিষদকে।
এমন পরিস্থিতিতে ২০২২ সালে ২৮ মে পুরস্কারের জন্য তাঁদের আবেদন প্রত্যাহার করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। যা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সে সময় ফলাও ভাবে প্রচার হয়। ওই ঘটনার প্রায় দুই বছর পর বৃক্ষরোপণের জন্য প্রশংসিত হাটহাজারীর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমীনকে ‘তিরস্কার’ এর শাস্তি প্রদান করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়!
মোহাম্মদ রুহল আমীন এখন বাংলাদেশ চা বোর্ড, চট্টগ্রামে সচিব (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আজ মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “রুহুল আমীন ২০২২ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষমেলার প্রাক্কালে হীন ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল না হওয়ায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ও আইনসম্মত কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এর মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন।”
যদিও ওই প্রজ্ঞাপনে রুহুল আমিনের বাগান সৃজনের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “রুহল আমীনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮–এর ৩(খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে তিনি বেশ কয়েকটি বাগান সৃজন করে জনস্বার্থের জন্য ইতিবাচক কাজ করেছেন বিধায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও তাঁকে সর্বনিম্ন দণ্ড ‘তিরস্কার’ দণ্ড প্রদান করা সমীচীন বলে প্রতীয়মান হয়।”
সাবেক ইউএনও রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে এই দণ্ড প্রদানের কারণ হিসেবে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকাকালে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২২ এর জন্য আবেদন করেছেন।”
একইভাবে রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে এই দণ্ড প্রদানের আরেকটি কারণ হিসেবে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কার গ্রহণের সুযোগ না থাকায় মিথ্যা তথ্য ও জাল কার্যবিবরণী সহকারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের সচিব বরাবর গত ২৮ মে ২০২২ পুরস্কারের আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন এবং অনুরুপ মিথ্যা তথ্য ও জাল দলিল সরবরাহ করে একাধিক জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করানোর মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও সরকারে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন।”
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই প্রজ্ঞাপন দেখে হতবাক হয়েছেন হাটহাজারীর তথা চট্টগ্রামের মানুষ। যে ব্যক্তির দক্ষতায় হাটহাজারীর দুর্গম মনাই ত্রিপুড়া পল্লী, বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষিত হালদা নদীর সুরাক্ষায় যার অবদান ছিলো সর্বজন প্রশংসিত। যিনি নিজ উদ্যোগে ৩০ হাজার বৃক্ষরোপন করে সুশোবিত করেছিলেন হাটহাজারী উপজেলা, সেই কর্মকর্তার উল্টো শাস্তির মুখে পরার ঘটনা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম বলেন, ‘রুহুল আমিন সাহেব একজন সাহসী এবং সৎ মানুষ। তিনি দুর্নীতি মুক্ত ছিলেন। উনি যা করেছেন নিজের জন্য নয়, এলাকার জন্য করেছেন। মূলত ভালো কাজ করলে অনেকে তাকে পছন্দ করেন না।’
এ বিষয়ে কথা বলতে হাটহাজারীর সাবেক ইউএনও রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ নিয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
আবেদন ছাড়াই পুরস্কার পায় হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ :
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৯, ২০২০ সালে কোনো গাছ লাগায়নি। বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কারের জন্য উপজেলাটির পক্ষ থেকে আবেদনও ছিলো না। উপজেলা পর্যায়ের কমিটি থেকে পাঠানো সুপারিশের তালিকাতেও ছিলো না উপজেলা পরিষদের নাম। অথচ ২০২২ সালে বৃক্ষরোপণে বিশেষ অবদান রাখায় জাতীয় পুরস্কার পায় হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উপজেলা কমিটি ব্যক্তিপর্যায়ে বৃক্ষরোপণের জন্য ‘চ’ শ্রেণিতে পুরস্কারের জন্য রুহুল আমীন ও শারমীনকে মনোনীত করা হয়। অথচ ওই বছরের ১১ মার্চ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ‘গ’ শ্রেণিতে পুরস্কারের জন্য লেখা হয় হাটহাজারী উপজেলার নাম।
বিষয়টি স্বীকার করে সে সময় হাটহাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান রাশেদুল আলম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো গাছ লাগাইনি, মালি দিয়ে পরিচর্যাও করাইনি। ২৬ মে হঠাৎ পুরস্কারের বিষয়ে ফোন পাই। আমি কোনো আবেদন করিনি। পুরস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।’
পরে ২৬ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ১০টি শ্রেণিতে ‘বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০২০’–এর চূড়ান্তভাবে মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ করে। হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ ‘গ’ শ্রেণিতে প্রথম পুরস্কার পায়। তালিকা থেকে বাদ যায় রুহুল আমীন ও ফারজানা শারমীনের নাম।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২৮ মে আবেদন প্রত্যাহার করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। তাতে বলা হয়, আবেদন না করেও উপজেলা পরিষদ পুরস্কার পাচ্ছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদ বৃক্ষরোপণে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উপজেলা পরিষদের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উপজেলা কমিটি মূল্যায়ন করে যেসব ছবি ও তথ্য উপাত্ত পাঠিয়েছে, সেগুলো তাঁদের ব্যক্তিগত কাজ।
সচিবের কাছে করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘আমাদের বৃক্ষরোপণের কর্মকাণ্ড দেখিয়ে অন্য কাউকে পদক না দিতে অনুরোধ করছি।’ তবে এই আবেদনের পরও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো প্রায় দুই বছর পর রুহুল আমীনকে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারের বদলে তিরস্কার।













