২৭ অক্টোবর ২০২৫

কক্সবাজার মডেল হাই স্কুল

কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু বুধবার

স্বেচ্ছাচারিতায় অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গেল ছয় বছরে বিদ্যালয়ের কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজার মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমজান আলীর বিরুদ্ধে। একছত্র আধিপত্য বিস্তারে শিক্ষকদের মাঝে বিভাজন গড়ে তৈরি করেছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাসের পরিবর্তে বাধ্যতামূলক কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে আসছেন অতিরিক্ত টাকা। এতে ভেঙে পড়েছে বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা। এমন সব অভিযোগ তুলে, চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন অভিভাবক মহল। বুধবার (১২ জুন) এসব বিষয়ে তদন্ত করতে স্কুলে আসছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত টিম।

অনিয়মের এসব বিষয় প্রকাশ পেয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধান শিক্ষক রমজান আলীর অপসারণ দাবি করেছেন অভিভাবক মহল।

জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫’মে আবদুর রহমান নামের এক অভিভাবক চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে কক্সবাজার মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক কে. এম. রমজান আলীর অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ-আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে জেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশনা দেন শিক্ষাবোর্ড। গত ২০ মে ২৪৫ নম্বর স্বারকে শিক্ষা ও কল্যাণ শাখার সহকারী কমিশনার মির্জা মো. তাওসীফ শরীফ স্নিগ্ধ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বোর্ডের নির্দেশনা পাঠান।

অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া কক্সবাজার সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, কক্সবাজার মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বুধবার (১২ জুন) অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত দুইজনের স্বাক্ষর নেয়া হবে। বাকিটা তদন্তের পর বলা যাবে।

অভিযোগকারী আবদুর রহমান বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নানা অনিয়মে অর্থ আত্মসাত ও কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছেন প্রধান শিক্ষক রমজান আলী। তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয় ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার স্বার্থে আমি অভিযোগ করেছি।

তথ্য মতে, বিদ্যালয়ে ১২০০ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এ হিসেবে ভর্তি ফরম, ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, টার্ম পরিক্ষা ফি, মডেল টেস্ট, প্রশংসাপত্র ফি- মিলে প্রতিবছর শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদ্যালয়ে কোটি টাকার উপরে আয় হয়। অথচ ব্যাংকে স্থিতি বলতে থাকে মাত্র কয়েক লাখ টাকা। ২০২২ সালের হিসাবে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোট আয় হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ২২ হাজার ১০০ টাকা। এরআগে ২০২১ সালে ব্যাংকে স্থিতি ছিলো ৪১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সে হিসাবে দুই বছরে এক কোটি ৫৫ লাখ ৫২ হাজার ১০০ টাকা স্থিতি থাকার কথা। কিন্তু প্রধান শিক্ষক অফিস ও আপ্যায়ন খরচ হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা, টার্ম পরিক্ষা ব্যয় ৩ লাখ টাকা, বেতন বোনাস সাড়ে ৪৮ লাখ টাকা আরও অন্যান্য ব্যয় দেখানোর পরে ব্যাংকে স্থিতি থাকার কথা ছিল ৮৩ লাখ ৬২ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্যাংক স্থিতি রয়েছে শুধুমাত্র ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকা। বিদ্যালয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথায় গেল সেই প্রশ্ন এখন অভিভাবক মহলের। প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালে ২৫ এপ্রিল ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা’ বোর্ড চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে অবহিত করেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি)।

শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়, নিজের অপরাধ আড়াল করতে বিদ্যায়ের ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনও কৌশলে বন্ধ রেখেছেন প্রধান শিক্ষক। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩১ মে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সঠিক সময়ে নির্বাচনের কাগজপত্র শিক্ষাবোর্ডে প্রেরন না করায় নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর কারণ দর্শাতে সাতদিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে প্রধান শিক্ষককে নির্দেশ দেন শিক্ষাবোর্ড। একই বছর ১৬ আগস্ট বোর্ডের কাছে ক্ষমা চান প্রধান শিক্ষক। বিধিমালা না মেনে ২ জন শিক্ষক, ১জন কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ দেন। একই সাথে কোন প্রকার টেন্ডার ছাড়া ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষক নিজের পছন্দের ও অনুগত শিক্ষক দিয়ে নতুন এডহক কমিটি গঠনে শিক্ষাবোর্ডে সুপারিশ পাঠান। এ কমিটি প্রবিধানমালা ২০০৯-এর বিধি ১২ অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ এপ্রিলের মধ্যে ভোটার তালিকা সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো কাজই করেননি এডহক কমিটি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কমিটি না থাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভাতা উত্তোলনে প্রধান শিক্ষকের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর নেয়া বাধ্যতামূলক করেন শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু তাও মানেননি রমজান আলী।

বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক এহসান উদ্দিন বলেন, প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম এবং শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করায় তিনি আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছেন। আমি ইংরেজি শিক্ষক হওয়ার পরও আমাকে জোর করে ইতিহাস পড়াতে বাধ্য করেন। আর ধর্ম শিক্ষক দিয়ে পড়ান ইংরেজি। এতে কোয়ালিটি শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। সাড়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রধান শিক্ষক।

গণিত বিভাগের বহিষ্কৃত শিক্ষক আবুল হোসেন বলেন, কোন কারণ ছাড়া আমাকে মানসিক নির্যাতন করেন প্রধান শিক্ষক রমজান আলী। আমি দুর্নীতিগ্রস্ত এ শিক্ষকের শাস্তি দাবি করছি।

জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক কে এম রমজান আলী বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তা সত্য নয়। একটি অসাধু চক্র স্কুলের সুনাম নষ্ট করতে মূলত আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। টাকার স্থিতির বিষয় নজরে আনা হলে, বলেন-এর সবিশেষ তদন্ত টিমকে জানাবো।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ