কক্সবাজারে সরকারি খাস জমি জবর-দখলের মহোৎসব চলছে। পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণ ও বিপুল পরিমাণ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় দিন দিন দাম বাড়ছে কক্সবাজারের ভূ-সম্পত্তির। ফলে, কৌশলে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ কিংবা মিথ্যে তথ্যে আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা বা ভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চলছে দখল কার্যক্রম। যেসব দখল নিয়ে গণমাধ্যম সংবাদ হলে. সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও তা দখলমুক্ত করণে কার্যকর ভূমিকা না থাকায় পুনরায় তা অবৈধ দখলে চলে যায়। এসব ‘উচ্ছেদ নাটক’ দেখে নতুন নতুন জায়গা দখলের ঘটনা ঘটছে নিত্য। তবে, কি পরিমাণ সরকারি জমি দখল বা জবরদখলে রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই জেলা প্রশাসনে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, জেলার ৯ উপজেলায় খাস জমি রয়েছে ৭২ হাজার ৮১২ দশমিক ৩৬৫ একর। যেখানে কৃষি জমি ৩৬ হাজার ৯৬০ দশমিক ২১৫ এবং অকৃষির পরিমাণ ৩৫ হাজার ৮৫২ দশমিক ১৫ একর। তবে- কি পরিমাণ খাসজমি বেদখলে আছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই জেলা প্রশাসনের কাছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, কক্সবাজারে সরকারি খাস জমির ৭০ শতাংশই বেদখল রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, হোটেল-মোটেল জোন এলাকায় সরকারি খাস জমির প্লট দখলদারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা পেয়ে নিরব ভূমিকা পালন করে জেলা প্রশাসন। ফলে বছরের পর বছর সরকারি জমি বেদখল থাকছে। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, সরকারি খাস জমি দখলের খবর পেলেই তারা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। ভবিষ্যতে স্থায়ী ভাবে তা পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
সূত্র মতে, ইকোলোজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) রক্ষায় কক্সবাজারের বেলাভূমির নিকটবর্তী এলাকায় স্থাপণা নির্মাণে ২০১৮ সারে নিষেধাজ্ঞা দেয় উচ্চ আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় চারদলীয় জোট সরকার আমলে বরাদ্দ দেয়া কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনে খালি থাকা ৫৭টি প্লট বাতিল করে সরকার। ২০২০ সালে এসব প্লটে বাতিল এবং তা জেলা প্রশাসনের সম্পত্তি বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিলেও দখল উচ্ছেদে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। শুধু এই ৫৭ প্লট নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ‘কক্সবাজার মহকুমায় অবকাঠামো সম্প্র্রসারণ ও স্বাস্থ্য নিবাস প্রকল্প’র জন্য তৎকালীন সরকারের অধিগ্রহণ করা শহরের বাহারছড়া সার্কিট হাউস এবং কলাতলী আনবিক শক্তি কমিশন এলাকার প্রায় দশ একর সরকারি জমি বেদখল রয়েছে। এক দিকে ইসিএ, আরেক দিকে সরকারি খাস জমি হলেও বিনাবাঁধায় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোন এলাকার ৫৭টি প্লটের বেশ কিছু পরিত্যক্ত পড়ে থাকলেও সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার বাসিন্দা বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন শাওন একটি প্লট দখল করে গড়েছেন ড্রাগন মার্কেট, চন্দনাইশ এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবচার নামের ব্যক্তি দখল করে নির্মাণ করেছেন সী-ইন মার্কেট, টুয়াক নেতা হিসেবে পরিচিত জনৈক কিবরিয়া দখলে নিয়ে গড়েছেন ফুড ভিলেজ। সার্কিট হাউস এলাকায় মো. আব্দুল্লাহ, মো. মুসা এবং জসিম উদ্দিন খাস জমিতে গড়েছেন বহুতল ভবন। কক্সবাজারে কস্তুরাঘাট এলাকায় পেশকার পাড়ার ফরিদুল আলম নামের এক ব্যক্তি সিন্ডিকেট করে দখলে রেখেছেন কয়েক একর সরকারি খাস জমি। খাস জমিতে ঘর করতে গিয়ে দখল করে ফেলেছেন কালভার্টের মুখও। ফলে, পানি নিষ্কাশনে বাঁধা পেয়ে অল্প বৃষ্টিতেই দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।
এছাড়াও কলাতলীর সৈকত পাড়া, লাইট হাউস পাড়া, বিমানবন্দর এলাকা, কস্তুরাঘাট নতুন ব্রীজ, ঘোনারপাড়া, মোহাজের পাড়ার সরকারি জমির ৯০ শতাংশ বেদখল হয়ে রয়েছে। খাস জমি উদ্ধার নিয়ে সমালোচনার মুখে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট সার্কিট হাউস এলাকায় গিয়ে উচ্ছেদে যাওয়া হলেও এর পরবর্তী কোন পদক্ষেপ নেয় হয়নি।
কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামী বলেন, কক্সবাজারে বেশিরভাগ খাস জমি অনেক আগেই বেদখল হয়েছে। মূল্যবান জমিতে গড়ে উঠেছে অনেক স্থাপনা ও বহুতল ভবন। বর্তমানে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দেয়া ১৫-২০টি ভবনের তথ্য নিয়ে কাজ করছি। তারা কিভাবে দখল করেছে, মামলা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অতীতে কি হয়েছে সেটি ভাবছি না। খাস জমি উদ্ধারে আমরা জরুরি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, শিগগিরই দেখতে পাবেন। সুগন্ধা পয়েন্টের ড্রাগন মার্কেট এবং সার্কিট হাউস এলাকার সকল দখলদারদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা চলছে। তবে, কি পরিমাণ খাস জমি বেদখলে আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
প্রশাসনের একটি সুত্র জানায়, সরকারি জমি বেদখল থাকায় কর্মকর্তাদের আবাসন সংকট দুর করা সম্ভব হচ্ছেনা। একই সাথে নির্মাণ করা যাচ্ছেনা হিলডাউন সার্কিট হাউস এলাকায় চীফ জুড়িসিয়াল আদালত ভবন। জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বহুতল ভবন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্টানের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাই দ্রæত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
গণপূর্ত অধিদপ্তর কক্সবাজারের আইনজীবী ফরিদুল আলম বলেন, সার্কিট হাউস এলাকার কিছু অংশ ছাড়া সবজমিই বিএস-১ এবং গণপূর্ত ৬নং খতিয়ানভূক্ত। গণপূর্ত বিভাগের অনেক জমিও খাস খতিয়ানে চলে গেছে। ইতিমধ্যে দখলদারের কাছ থেকে প্রায় ১২ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো যেসব জমি বেদখলে রয়েছে তা উদ্ধারের জন্য আইনী পক্রিয়া চলছে। সরকার চাইলে ভূমি অপরাধ আইনের ১০/১১/১২’ধারায় দখল উচ্ছেদ করা খুবই সহজ।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আনম হেলাল উদ্দিন বলেন, সরকারি জমি নিয়ন্ত্রণ কিংবা দখল পুনরুদ্ধারে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এ ব্যাপারে প্রশাসনের বয়ান ‘দায়সারা বা দায়িত্বহীন’। ইসিএ-র বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদেশও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ফলে সরকারি জমি দখল বাড়ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনে আমরা ফের আদালতের শরণাপন্ন হবো।
এ বিষয়ে জানতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানকে ফোন করা হলে তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)’র সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, বেদখল বা জবর দখলের খবর পাওয়া মাত্র অভিযান চালায়। প্রয়োজনে উচ্ছেদ মামলা করে অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় সরকারি কর্মচারী এবং জনসাধারণ সবার আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন এডিসি। তবে, কি পরিমাণ সরকারি জমি বেদখল তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনিও।