২৮ অক্টোবর ২০২৫

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অবৈধ সম্পদের পাহাড়

Hasan Mahmud

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রিত্ব করেন ড. হাছান মাহমুদ। তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক আওয়ামী সরকারের সর্বাধিক সুবিধাভোগীদের অন্যতম ছিলেন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন; অপরদিকে পাচারও করেছেন বিপুল অর্থ। তার প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ কত সেই হিসাব নেই কোনো দপ্তরে। গত ৬ আগস্ট পালানোর সময় বিমানবন্দরে আটক হন হাছান মাহমুদ। এরপর থেকে তিনি লাপাত্তা। তার হদিস না মিললেও তার বিরুদ্ধে চলছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিআইএফইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান। বিভিন্ন সূত্র থেকে তার সম্পদের কিছু ফিরিস্তি পাওয়া গেছে।

১৬ বছরে হাছান মাহমুদের সম্পদ বেড়েছে ৪৬৮৩ গুণ
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরে সর্বাধিক সুবিধাভোগীদের একজন হাছান মাহমুদ। তিনি টানা ১৬ বছরই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি দায়িত্ব পান বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর। ২০১৪ সালে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চট্টগ্রাম হাজী মহসিন কলেজের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। গত ৭ জানুয়ারি হয়ে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত ভাতা বাদে হাছান মাহমুদের বার্ষিক আয় ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। কিন্তু অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। দুদকে জমা হওয়া অভিযোগের তথ্য অনুযায়ী ১৬ বছরে হাছান মাহমুদের সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ৬৮৩ গুণ।

তিনি নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার মালিক। শুধু দেশেই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমানে পুরো একটি এলাকা কিনে করেছেন বাড়ি, হোটেলসহ বহু স্থাবর সম্পদ। চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজার এলাকায় একটি ১৫ তলা ভবনসহ সেখানে তিনটি বহুতল ভবন রয়েছে তার। ঢাকার পিংক সিটিতে রয়েছে তিনটি বাড়ি। প্লট ও বাড়ি আছে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাতেও। রাজধানীর চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) পাশে শতকোটি টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক প্লট কিনেছেন তিনি। নিজ নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতভিটাসহ জমি দখলেরও অভিযোগ আছে সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ১৬ দশমিক ১৯ একর পাহাড় দখল করে আবাসন প্রকল্প করেন। চট্টগ্রামের খুলশী, বাকলিয়া ও গাজীপুরের বিভিন্ন মৌজায় রয়েছে তার কয়েক একর সম্পত্তি। সম্পত্তি আছে চট্টগ্রামের সিরাজুদ্দৌলা সড়কেও। বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও এফডিআর। বাড়ি কিনেছেন কানাডায়। চট্টগ্রামের মাতারবাড়ীতে কয়লাবিদ্যুৎ ও গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজের নানা ঠিকাদারি তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এসবের কোনোটিই তার আয়কর বিবরণী বা হলফনামায় উল্লেখ নেই।

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনী হলফনামায় হাছান মাহমুদ বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকানভাড়া খাতে বছরে আয় ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, কৃষি খাতে ১ লাখ ৩০ হাজার, ব্যাংক ও অন্যান্য খাত থেকে সম্মানী বাবদ আয় ১ লাখ ২২ হাজার ২৬৩ টাকা উল্লেখ করেন। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত ভাতা বাদ দিলে হাছান মাহমুদের বাৎসরিক আয় ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। আর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বার্ষিক আয় ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এবার তার নামে ঋণ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে তার ব্যক্তিগত ঋণ রয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। জামানতবিহীন ঋণ আছে ৯১ লাখ টাকার। ভাইদের কাছ থেকে ঋণ রয়েছে ১২ লাখ টাকার।

জানা গেছে, হাছান মাহমুদ মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে রূপালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। ১১ বছরের বেশি সময় ধরে ১ টাকাও পরিশোধ করেননি। এরপরও নিয়মিত আছে তার ঋণ। প্রভাব খাটিয়ে অভিনব কায়দায় কিস্তি পরিশোধের সময় এলেই গ্রেস পিরিয়ড তথা পরিশোধ শুরুর সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সুদ মওকুফ করে নিয়েছেন কয়েক দফা। এখন ব্যাংকের পাওনা ১৯ কোটি ৩ লাখ টাকা।

হাছান মাহমুদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ১৬ একরের বেশি পাহাড়ি ভূমি দখল করেন। তার চাপে সেখানে ২০১৪ সালে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) একটি প্রকল্প নেয়। গত সোমবার ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন’ শীর্ষক আবাসন প্রকল্পটির পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। জাগৃক সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্প এলাকার ৭০ শতাংশ পাহাড় ও ৩০ শতাংশ জলাধার হওয়ায় বিভিন্ন সংস্থার আপত্তিতে প্রকল্পটি প্রথমেই বাতিল করা হয়। তবে হাছান মাহমুদের চাপে আগের মতামত বাদ দিয়ে নতুন করে প্রকল্প অনুমোদন করানো হয়। ২০২০ সালের মার্চে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। প্রকল্পে ১৬ দশমিক ১৯ একর জমি ধরা হলেও ১৪ দশমিক ১৯ একরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৪১ কোটি ৮৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৩৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় ভূমি অধিগ্রহণে। প্রকল্প গ্রহণের সময় হাছান মাহমুদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। এ বছরের ৬ জুন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শর্তসাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদন করেন। শর্তের মধ্যে ছিল পাহাড়ি ভূমি ও জলাশয়ের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যাবে না। গত ১১ আগস্ট হাছান মাহমুদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

আরও পড়ুন