২৪ অক্টোবর ২০২৫

মিরসরাইয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে স্কুল কর্মচারীকে রাজকীয় বিদায়

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে স্কুল কর্মচারীকে রাজকীয় বিদায় দিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। চার প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় নুরুল আবছারও ছিলেন স্কুল কর্মচারী। তার প্রপিতামহ বাদশা মিয়া, দাদা ছেরাজুল হক, বাবা মুন্সি মিয়া—এরপর তিনি কর্মচারী হিসেবে ১২ বছর বয়সে যোগ দেন মিরসরাই উপজেলার শতবর্ষী জোরারগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৪৮ বছরের পথচলায় বিদ্যালয়ের শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটান নুরুল আবছার। শিক্ষার্থীরা তাকে ‘আবছার কাকু’ বলে সম্বোধন করতেন, অন্যদিকে শিক্ষকরা ডাকতেন ‘আবছার ভাই’ বলে। প্রায় পাঁচ দশকের কর্মজীবন শেষে অবসরজনিত কারণে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেন তিনি। একজন কর্মচারীর বিদায় অনুষ্ঠান রাজকীয় হয়ে উঠল বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের মায়া, মমতা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতায়।

বিদায় সব সময়ই বেদনার। তবে সেই বিদায় বেদনা ছাপিয়ে কখনো কখনো চিরস্মরণীয় হয়ে ওঠে। এই স্কুলের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় এক বিদায় সংবর্ধনা পেলেন নুরুল আবছার। রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে তাকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল হাই-এর সভাপতিত্বে এবং শিক্ষক নিতাই দাশের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলম, আছিউর রহমান, রেজাউল করিম, তারেক নিজামী, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের অভিভাবক সদস্য আবু সুফিয়ান চৌধুরী, শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস, মারিয়া আক্তার, কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস হাবিবা, মেহেদী হাসান, তাহসিনা তাবাচ্ছুম তানিশা, বিবি ফাতেমা ও ওবায়দুল ইসলাম চৌধুরী। এ সময় অনুভূতি ব্যক্ত করেন সংবর্ধিত স্কুল কর্মচারী নুরুল আবছারও। তিনি তার বক্তব্যে এমন আয়োজনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

সংবর্ধনার পূর্বে ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটান তিনি। এরপর স্কাউট দলের সদস্যরা তাকে কাঁধে তুলে সংবর্ধনাস্থলে নিয়ে যান। একসময় শিক্ষকদের পাশাপাশি একসারিতে অনুষ্ঠানে বসার সুযোগ না পেলেও, আজ অনুষ্ঠানের মধ্যমণির আসন অলংকৃত করেন নুরুল আবছার।

সংবর্ধনায় সহকর্মী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তার কর্মময় জীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। নানা উপহার সামগ্রী ও অর্থ সহায়তা দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সংবর্ধনা শেষে অনেকটা বরের সাজে নুরুল আবছার ঘোড়ার গাড়িতে করে বিদায় নেন প্রিয় শিক্ষাঙ্গন থেকে। স্কাউট দলের সদস্যরা বাদ্যের তালে তালে এবং বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী সারিবদ্ধভাবে তাকে জোরারগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ শেষে বাড়ি পৌঁছে দেন। এ সময় এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি হয়।

সংবর্ধিত স্কুল কর্মচারী নুরুল আবছার বলেন, “১৬০ টাকা বেতনে এই স্কুলে চাকরি শুরু করি। এরপর একপর্যায়ে তিন মাস মিলিয়ে সরকারিভাবে ৩৬০ টাকা বেতন পেতাম। আজ আমার বিদায়ের মধ্য দিয়ে আমাদের চার প্রজন্মের কর্মচারী হিসেবে চাকরি জীবনের সমাপ্তি হলো। আমার চাকরি জীবনে অনেক শিক্ষক, কর্মচারী এই স্কুলে চাকরি করেছেন, চাকরি ছেড়েছেন। তবে আমাকে যেভাবে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে, তা আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি বর্তমান প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলমসহ সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞ।”

বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমাদের স্কুলের সকলের প্রিয় নুরুল আবছার ভাই তার জীবনের বেশির ভাগ সময় এই স্কুলের জন্য দিয়ে গেছেন। তিনি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই স্কুলের প্রতিটি ধূলিকণা নুরুল আবছারের অবদানকে স্মরণ করবে। তার অবসরকালীন সময় ভালোভাবে কাটুক—এই কামনা করি।”

বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, “আমাদের বিদ্যালয়ের কর্মচারী নুরুল আবছার তার জীবনের মূল্যবান সময়টুকু এই বিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন। তার বর্ণাঢ্য বিদায় অনুষ্ঠানের মাঝেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এখানে শেখার মতো বিষয় হলো—ভালো কাজ করলে ও সততার সঙ্গে চললে তার কখনো না কখনো স্বীকৃতি মেলে। অবশেষে নুরুল আবছারও তার ভালোভাবে কাটানো কর্মজীবনের স্বীকৃতি পেলেন।”

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলম বলেন, “১২ বছর বয়স থেকে নুরুল আবছার এই স্কুলে কর্মচারী পদে যোগ দেন। তিনি আমার খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। এতটাই বিশ্বস্ত যে বিদ্যালয়ের সকল লেনদেন তিনিই করতেন। অনেক সময় ৮-১০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য নিয়ে যেতেন, আবার বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ৮-১০ লাখ টাকা তুলে আনতেন। আমি এই বিদ্যালয়ে পাঠদান করছি প্রায় ১৮ বছর। এর মধ্যে তিনি কখনো এক টাকাও এদিক-সেদিক করেননি। এমন বিশ্বস্ত কর্মচারী আমরা আর পাবো কিনা জানি না। তিনি বেশি শিক্ষিত না হলেও প্রতিটি ফাইলপত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দেখভাল করতেন।”

আরও পড়ুন