২৩ অক্টোবর ২০২৫

টাকা বা কাগজ স্পর্শেই সর্বস্বান্ত: চট্টগ্রামে শয়তানের নিঃশ্বাস

আপনার এক মুহূর্তের অসচেতনতা আপনাকে ভয়ঙ্কর বিপদে ফেলে দিতে পারে। অপরিচিত কেউ করমর্দন, টাকা ভাঙানোর অনুরোধ, বা একটি ঠিকানা জানতে কাগজ দেখালে সাবধান!

বিশ্বজুড়ে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ নামে পরিচিত স্কোপোলামাইন নামক ড্রাগটি ব্যবহার করে প্রতারক চক্র মানুষকে মুহূর্তেই বশীভূত করছে। শ্বাস, স্পর্শ বা খাবারের মাধ্যমে ড্রাগটি শরীরে প্রবেশ করানো হয়। একবার এটি শরীরে ঢুকে পড়লে ভুক্তভোগী পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।

চট্টগ্রামে স্কোপোলামাইনের ভয়াবহতা

সম্প্রতি চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় একটি ফার্মেসিতে প্রতারণার শিকার হন পল্লব মজুমদার। অপরিচিত এক ব্যক্তি করমর্দনের মাধ্যমে স্কোপোলামাইন প্রয়োগ করে তার কাছ থেকে সবকিছু লুটে নেয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর রবিউল ইসলাম বলেন
“প্রতারক নিজেকে সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয় দিয়েছিল। পরে তার পরিচয় ভুয়া প্রমাণিত হয়। এটি একটি শক্তিশালী ড্রাগ, যা মানুষের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ধ্বংস করে এবং তাকে পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। চট্টগ্রামে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।”

গোয়েন্দা বিভাগের আরেক কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি কায়সার জানান, “স্কোপোলামাইন সাধারণত হ্যান্ডশেক, কাগজের টুকরো, চিরকুট, এমনকি খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকেও শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। তরল বা পাউডার দুই ফরম্যাটেই এটি পাওয়া যায় এবং এর প্রভাব ২০ থেকে ৬০ মিনিট স্থায়ী হতে পারে। খাবারের মাধ্যমে প্রবেশ করালে এর প্রভাব দু-তিন দিনও থাকতে পারে। তবে আমাদের সহকর্মী এসআই রবিউল ইসলাম আরো ভালো তথ্য জানাতে পারবেন।’

বাংলাদেশে স্কোপোলামাইন ব্যবহারের নজির

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে একটি শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের তদন্তে স্কোপোলামাইনের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, “এই ড্রাগটি মূলত মেক্সিকোর মাদক চক্র তৈরি করে। ধুতরার ফুল থেকে একটি নির্যাস নিয়ে সিনথেটিক পদ্ধতিতে স্কোপোলামাইন তৈরি করা হয়। এটি এখন অপরাধের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।”

স্কোপোলামাইনের প্রভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সায়েদুর রহমান বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্কোপোলামাইন ট্রুথ সেরাম হিসেবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহার করত। এটি মানুষের মস্তিষ্কের ওপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করে দেয় এবং তাকে অপরাধীদের কথামতো চলতে বাধ্য করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি এখনও মোশন সিকনেস বা অপারেশন-পরবর্তী রোগীদের জন্য ব্যবহার হয়, তবে অপরাধীরা এটিকে ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।”

সিএমপি কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ইন্সপেক্টর মো. আফতাব হোসেন বলেন, “ড্রাগটির প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে অপরাধীরা মানুষের মন নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম। সচেতনতার পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, যা বায়ুবাহিত স্কোপোলামাইন থেকে সুরক্ষা দেবে। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।”

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. আফলাতুন আকতার জাহান বলেন, “রাস্তা বা যানবাহনে চলাচলের সময় অপরিচিত কারো কাছ থেকে খাবার বা পানীয় গ্রহণ করবেন না। কেউ কোনো কাগজ বা ভিজিটিং কার্ড মুখের সামনে ধরলে সতর্ক হোন। মাস্ক ব্যবহার করলে এটি শ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ প্রতিরোধ করতে পারে। আক্রান্ত হলে দ্রুত নিকটস্থ থানা বা হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।”

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “স্কোপোলামাইন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি ড্রাগ। এটি শ্বাস, স্পর্শ বা খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে নিয়ন্ত্রণে এনে সর্বস্ব লুট করে নেয়। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।”

সতর্ক থাকুন, সচেতন হোন

স্কোপোলামাইন বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ এখন চট্টগ্রামের মতো শহরেও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এটি প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এড়াতে সর্বদা সতর্ক থাকুন এবং অপরিচিত কোনো প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার আগে দুইবার ভাবুন।

আরও পড়ুন