২৩ অক্টোবর ২০২৫

সাবেক প্রতিমন্ত্রীর দাপুটে জামাই বিশ্ব প্রদীপ মূর্তিমান আতঙ্ক: গড়েছেন সম্পদের পাহাড়

বাদ যায়নি মন্দিরের জায়গা জবর দখল ও সরকারি বরাদ্ধ

খাগড়াছড়ির সীমান্ত শহর রামগড় জনপদের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী ত্রিপুরা। তিনি সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাগিনীর জামাই। সেই সুবাধে প্রভাব খাটিয়ে আশ্রয়ন প্রকল্প থেকে শুরু করে সর্বত্রই তার ছিল ভয়ংকার চাঁদাবাজি ও দূর্নীতির থাবা। গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। আওয়ামীলীগের সাড়ে ১৫ বছরে তার নির্যাতন, নিপীড়ন ও দখলবাজিতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়।

শ্বশুরের ক্ষমতার দাপটে কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ না করে বিল উত্তোলন ও প্রতিবাদীদের নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে বিরোধীদলের পাশাপাশি ও নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও এলাকা ছাড়া করেছেন। তিনি এখন ভূ-সম্পত্তিসহ ৩শত কোটি টাকার মালিক।

নিজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য শত বছরের মন্দিরের জায়গা দখল করেছেন তিনি। কাজ না করে কালী বাড়ী মন্দিরের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাত করেছেন। অন্যের জমি দখল করে অন্তত ৫শত একর পাহাড়ি-টিলায় গড়ে তুলেছেন বাগান-বাগিচা। সে বাগানে সরকারি অর্থে বিদ্যুতের লাইন, পানি সরবরাহের জন্য প্রকল্প দিয়েছেন।

খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্ত শহর রামগড় উপজেলার জগন্নাথ পাড়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক দুই বারের বিনা ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী ত্রিপুরার রয়েছে আন্ডার গ্রাউন্ডসহ বিলাস বহুল বাড়ী।

স্থানীয় মৃনাল কান্তি শীলের অভিযোগ বিশ্ব প্রদীপ ত্রিপুরা তার বাড়ীতে যাওয়ার জন্য রাস্তা করতে গিয়ে তার ও একশ ২৭ বছর আগে ১৯০২ সালে স্থাপিত শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দিরের জায়াগা দখল করেছেন। একইভাবে গীতারানী দেবীর জায়গাও দখল করেছেন। তবে তাদেরকে কোনো ক্ষতিপুরণও দেয়া হয়নি। এ যেন সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি।

আওয়ামী লীগ নেতা বিশ্ব প্রদীপ কুমার ত্রিপুরার সাড়ে ১৫ বছরে নানা অপকর্মের প্রতিবাদ করতে না পারলেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। তবে শেখ হাসিনা আবার দেশে ঢুকে পড়ে কিনা এ ভয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের চোখে-মুখে আতংক দেখা গেছে। তারা যেন ভাসুরের নাম নিতে ভয় পায়।

শ্রী শ্রী দক্ষিণেশ্বরী রামগড় কালী মন্দিরটি আজ থেকে একশ ৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে মন্দিরের বরাদ্ধও আত্মসাত করেছেন বিশ্ব প্রদীপ কার্বারী ত্রিপুরা।

শ্রী শ্রী দক্ষিণেশ্বরী রামগড় কালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শুভাশীষ দাসের অভিযোগ, মন্দিরের উন্নয়নে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রায় ৩২ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়। বিশ্ব প্রদীপ কার্বারী ত্রিপুরা একাধারে উপজেলা চেয়ারম্যান ও কালী বাড়ী উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন। তিনি কাজ না করে পুরো টাকাই আত্মসাত করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী ত্রিপুরার বাবা ছিলে সাবেক পুলিশ সদস্য। এক সময় সে রামগড়ে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াত।পরে নাম লেখান যুবলীগে। সীমিত আয়ের সংসারের চাকা ঘোরানো ছিল কষ্টকর। বিশ্ব প্রদীপের সন্ত্রাসের অভিজ্ঞতা দেখে নজড়ে পড়ে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার। রাতারাতি হয়ে যান রামগড় উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর বিয়ে করেন সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাতিজিকে। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে অর্থবিত্তে পুরো খাগড়াছড়িতে যুবরাজ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সীমান্তে মাদক ব্যবসা, ক্যাসিনো আদলের শিলং জুয়া পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্ব প্রদীপের রয়েছে, চিনছড়ি পাড়া, তৈচালা পাড়া, পাতাছড়া ও খাগড়াবিল এলাকায় প্রায় পাঁচশত একর বাগান-বাগিচা। এ সব শ্বশুর সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার প্রভাব খাটিয়ে সরকারি অর্থে বাগানে প্রকল্প, সোলার প্যানেল স্থাপন, রাস্তা, বৈদ্যুতিক লাইন ও পানি প্রকল্প নিয়েছেন।

খোদ রামগড় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মো: নুরুল আলমের অভিযোগ, বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী একাধারে ছিলেন রামগড় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান। তার ছিল বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। তিনি কখনও গোপন বাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়ে, কখনও উপজেলা চেয়ারম্যান পদের দাপট খাটিয়ে চাঁদাবাজি করত। চাঁদাবাজি , টেন্ডারবাজি, অন্যের জমি জবরদখল, ব্যবসা বাণিজ্য ছিনিয়ে নেওয়াসহ সব ধরনের অপরাধ অপকর্ম ছিল তার বাহিনীর। আওয়ামী লীগ বা প্রশাসন সবই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আঞ্চলিক পাহাড়ি সংগঠনগুলোর নামেও গুপ্ত চাঁদাবাজি , টেন্ডারবাজি, জবর দখল সবকিছুই চলতো। আর এই সবের নেপথ্যে শক্তি হচ্ছে তিনি সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাতিজি জামাই।

সীমান্তবর্তী রামগড় পৌরসভার দুই বারের সাবেক মেয়র মো: কাজী শাহজাহান রিপন, সর্বশেষ মেয়র মো: রফিকুল আলম কামাল ও পৌর কাউন্সিলার মো: বাদশা মিয়ার বিরুদ্ধেও একই প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

কি বলছেন অভিযুক্ত বিশ্ব প্রদীপ কুমার কার্বারী ত্রিপুরা

তথ্য সংগ্রহের জন্য এ প্রতিবেদক রামগড় অবস্থানের সময় থেকে অভিযুক্ত বিশ্ব প্রদীপ কার্বারীর ত্রিপুরা অজ্ঞাত স্থান থেকে এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি কোনো অনিয়ম করেননি। তার জনপ্রিয়তায় ইর্শ্বানিত হয়ে তার দলের লোকেরাই বিগত দিন থেকে নানা ষড়যন্ত্র করে আসছেন। তিনি বলেন, পাহাড়িদের সরকারকে আয়কর দিতে হয় না। তাই আয়কর ফাইলে সম্পত্তি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে সম্পত্তি বাড়লেও কোন সমস্যা না হয়। বিশ্ব প্রদীপ কার্বারী ত্রিপুরার দাবী বিগত সময়ে তিনি বিএনপি বা তার দলের কোন নেতাকর্মীর উপর নিপীড়ন নির্যাতন চালাননি। বরং সুবিধা দিয়েছেন। এ কারণে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী এখনো তার সাথে যোগাযোগ রাখছেন।

আরও পড়ুন