২৩ অক্টোবর ২০২৫

গাজায় প্রতিদিনই নিভে যাচ্ছে শৈশব

গাজা যেন আজ এক মৃত্যুপুরী। সেখানে প্রতিদিন ৩০টি শিশুর প্রাণ ঝরে যাচ্ছে—প্রতি ৪৫ মিনিটে মারা যাচ্ছে এক একটি নিষ্পাপ প্রাণ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত হয়েছে অন্তত ১৭ হাজার ৪০০ শিশু। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৬০০ শিশুর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাকিরা এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে।

এই শিশুরা শুধু নাম-পরিসংখ্যান নয়, প্রত্যেকেই ছিল একটি গল্প, একটি সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা থেমে গেছে বোমার আগুনে, ধ্বংসস্তূপের নিচে।

গাজার প্রায় ২৩ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকই শিশু। এই শিশুরা জন্ম থেকেই বেড়ে উঠেছে ইসরায়েলি অবরোধের নিষ্ঠুর বাস্তবতায়। বিগত ১৭ মাসে ইসরায়েলের আগ্রাসনে তারা হারিয়েছে ঘরবাড়ি, স্কুল ও চিকিৎসা সুবিধা। আজ তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এক প্রজন্মে পরিণত হয়েছে।

গাজার মানবিক বিপর্যয়ের চিত্রটা যদি ১০০ শিশুর দৃষ্টান্তে দেখানো হয়, তাহলে তার মধ্যে ২ জন নিহত, ২ জন নিখোঁজ (ধরা হচ্ছে মৃত), ৩ জন গুরুতর আহত, ৫ জন এতিম বা পরিবারবিচ্ছিন্ন, ৫ জন মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং বাকিরা মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত।

নিহতদের মধ্যে রয়েছে—

  • ৮২৫ শিশু এক বছর বয়সও পূর্ণ করতে পারেনি।

  • ৮৯৫ শিশু এক বছর বয়সী ছিল।

  • ৩,২৬৬ শিশু ছিল দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী।

  • ৪,০৩২ শিশু ছিল ছয় থেকে দশ বছরের মধ্যে।

  • ৩,৬৪৬ শিশু ছিল ১১ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।

  • ২,৯৪৯ কিশোর-কিশোরী ছিল ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী।

নিহতদের মধ্যে ৮,৮৯৯ জন ছেলে এবং ৬,৭১৪ জন মেয়ে।

ইসরায়েলি বাহিনী ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ গাজার ওপর একযোগে চালায় ১০০টি বিমান হামলা, যার মাধ্যমে ভেঙে পড়ে যুদ্ধবিরতি। ওই হামলায় ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে নিহত হন ৪৩৬ জন—তাদের মধ্যে ১৮৩ জনই শিশু।

শিশুদের কিছু করুণ গল্প

এক বছর বয়সী মোহাম্মদ আবু হিলাল ও তার অন্তঃসত্ত্বা মা আফনান নিহত হন আল-মাওয়াসি শরণার্থী শিবিরে। এই শিবিরকেই ইসরায়েল ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। বাবা আলা হিলাল সন্তানকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন, “স্বর্গে চলে যা সোনামনি, ওখানে তোর সব খেলনা তোকে অপেক্ষা করছে।”

রিম ও তারেক, তিন ও পাঁচ বছরের দুই ভাইবোন, নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে বিমান হামলায় নিহত হয়। রিমের দাদা খালেদ নিজের বুকের মধ্যে নাতনির নিথর দেহ জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তিনিও এক হামলায় প্রাণ হারান।

হিন্দ রাজাব, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে যুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার। আহত অবস্থায় রেড ক্রিসেন্টে ফোন করে বারবার বলেছিল, “আমি খুব ভয় পাচ্ছি, কাউকে পাঠান।” ১২ দিন পর উদ্ধার হয় তার নিথর দেহ।

সোহাইল (১৪), জুলি (১২) ও মজদ (১০)—তিন ভাইবোন প্রাণ হারায় গাজার পুরনো গির্জা সেন্ট পোরফিরিয়াসে আশ্রয়ের সময়। তাদের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “আমরা ভেবেছিলাম এখানে আমরা নিরাপদ… এখন একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় আল্লাহর ঘর।”

মাহমুদ, ১৫ বছর বয়সে স্বপ্ন দেখত সাংবাদিক হওয়ার। তার বোন খলুদের সঙ্গে গাজার বাস্তবতা তুলে ধরছিল ক্যামেরায়। ২৫ অক্টোবর রাতে এক হামলায় প্রাণ হারায় সে, তার মা, বোন শাম, ছোট ভাই আদমসহ ২১ জন।

এই নামগুলো—মোহাম্মদ, রিম, হিন্দ, সোহাইল, মাহমুদ—সবাই সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাদের শৈশব কেড়ে নিয়েছে যুদ্ধ। তারা ছিল গাজার আশা, ছিল গানের সুর, হাসির রং, ছিল আগামী দিনের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ বুলেটের গর্জনে স্তব্ধ।

-আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করা

আরও পড়ুন