২৩ অক্টোবর ২০২৫

মানিকছড়ি উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

জাতীয় দিবসেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন তিনি

খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. মহব্বত আলী কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকেই নিজের ইচ্ছে মতো অফিস করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা থাকলেও অফিসে দেরি করে আসার অভ্যাস তার পুরনো স্বভাব। আবার সকল দপ্তর বন্ধ করে উপজেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা বাসায় চলে গেলেও সরকারি ওই কর্মকর্তা অনেক রাত পর্যন্ত অফিস করেন। বসিয়ে রাখেন তার অফিসের অন্যান্য কর্মচারীদেরও।

সেই সাথে মানিকছড়ি উপজেলার দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় কোটি কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা বা মন্ত্রণালয়ে নতুন নতুন প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাঠালেও উপজেলার অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ বহু সড়কে উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনাই নেই তার। তার কারণ কি তা জানার জন্য অনেক চেষ্টা করেও জানা সম্ভব হয়নি। কেননা দুর্গম এলাকায় সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা হলে, একদিকে কাজের তদারকি করতে সরেজমিনে যান না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে ওই এলাকার উন্নয়নের চেয়ে প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন বেশি হয় বলেই প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায় কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে থাকেন মানিকছড়ি উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. মহব্বত আলী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি ওই কর্মকর্তা গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। অথচ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শহীদ মিনার সাজ সজ্জা উপ-কমিটির আহ্বায়কের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও উপজেলা প্রশাসনকে কোনো কাজে সহযোগিতা করেননি তিনি। যার ফলে মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারাও তার কাজকর্মে চরমভাবে অসন্তুষ্ট।

২৬ শে মার্চের মত জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসে তাকে তার কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালন করতে না দেখে উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা করতেও দেখা যায়। তাছাড়া পরের দিন ২৭ মার্চ গত বৃহস্পতিবারও তিনি তার কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না বলে জানান তার সহকর্মীরা।

বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেদিন তিনি তার ঢাকা শহরের বাসায় অবস্থান করছিলেন। মানিকছড়ি উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. মহব্বত আলীর কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আফরোজ ভূঁইয়া।

এদিকে আজ রবিবার (৬ এপ্রিল) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মানিকছড়ি উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলীর কার্যালয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একাধিকবার গেলে আজও তাকে তার কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাধারার প্রতিবেদককে জানান, বর্তমানে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। অফিসিয়ালি কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে তিনি কোনো ছুটি নিয়েছেন কিনা, তা জানতে চাইলে কোনো প্রকার সদুত্তর দিতে পারেননি এলজিইডি প্রকৌশলী মো. মহব্বত আলী।

তার অফিসের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ প্রকৌশলী মস্ত বড়ো দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জমিজমা ও সম্পদের মালিক। তার আচরণ অত্যন্ত খারাপ। অফিসের সবাই তার আচরণকে ভয় পায়। প্রায় সময় কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ছুটি না নিয়েই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন তিনি।

তাছাড়া সম্প্রতি বুঝে নেয়া মানিকছড়ি উপজেলার নব-নির্মিত প্রশাসনিক ভবণের নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিময় ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে সচেতন মহল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করলেও, তাতে কোনো কাজে আসেনি বলে তার প্রতি ক্ষিপ্ত রয়েছেন অনেকে। সরেজমিনে দেখা যায়, তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে এখন পর্যন্ত নতুন ওই প্রশাসনিক ভবণের অনেক কাজই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পূর্ণ করারও কোনো উদ্যোগ নেই তার। যার ফলে শোনা যাচ্ছে নানা ধরনের গুঞ্জন।

অভিযোগ রয়েছে, মানিকছড়ি উপজেলার স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজের মান ও অগ্রগতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য তার নিকট তথ্য চাইলেও তিনি নানা অজুহাতে তথ্য প্রদানে গড়িমসি করেন। তিনি দাম্ভিকতার সাথে বলেন “এ সব বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করে কি লাভ হবে? কে পড়ে আপনাদের নিউজ? তাছাড়াও সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সম্পর্কেও নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেন তিনি।

প্রকল্পের কাজের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাজের মান পনেরো-বিশ হলে সমস্যা নেই, দশ/বিশ হলে বলেন। তার এমন একরোখা ও নেতিবাচক মন্তব্যে বিব্রত সাংবাদিকরাও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঠিকাদার বাংলাধারার এ প্রতিবেদককে জানান, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের গুনগত মান ও ধরণ ঠিক নাই বলে আমাদের নিকট থেকে বিভিন্ন কৌশলে মোটা অংকের অর্থ ঘুষ আদায় করেন ওই প্রকৌশলী। তার নিকট এখানকার ঠিকাদাররা জিম্মি, কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। তাকে কাঙ্খিত ঘুষ প্রদানে অস্বীকৃতি জানালেই বাঁধে বিপত্তি, তখন ঠিকাদারের দোষের কোনো শেষ থাকে না বলেও জানান কয়েকজন ঠিকাদার।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দূর্গম এলাকায় সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে ভয়াবহ পুকুর চুরি, দুর্নীতি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. মহব্বত আলী। তার নিজ এলাকায় ও ঢাকা শহরে অনেক অর্থবিত্তের মালিক তিনি। পরিবারের সদস্যদের নামে- বেনামে রয়েছে অনেক সম্পত্তি।

দুর্নীতি দমন কমিশন মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করলে আরও অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে বলেও জানায় সূত্রটি।

তবে এ বিষয়ে আজ রবিবার বিকেলে ও রাতে একাধিবার খাগড়াছড়ি এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করা হলেও তিনি কোনো উওর দেননি। যার ফলে অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আফরোজ ভূঁইয়া বাংলাধারার প্রতিবেদককে জানান, এলজিইডি প্রকৌশলী মো. মহব্বত আলী গত ২৬ মার্চের জাতীয় প্রোগ্রামের দিন ও পরের দিন ২৭ মার্চ কর্মস্থলে ছিলেন না। আজ রবিবারও তিনি অফিসে আসেননি। কি কারণে তিনি তার কর্মস্থলে অনুপস্থিত, তা আমার জানা নেই। তবে তার এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে বলেও জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আফরোজ ভুঁইয়া।

আর খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, সরকারি কোনো কর্মকর্তা- কর্মচারী দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রথমত তার চাকুরি থাকবে না। তাকে কেউ কোনো প্রকার সহযোগিতাও করতে পারবে না। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, তা আমলে নেওয়া হয়। অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

এএস/এইচএ/বাংলাধারা

আরও পড়ুন