২৩ অক্টোবর ২০২৫

‘গোপন মামলায়’ সাংবাদিক আসামি: প্রশ্নের মুখে তদন্ত প্রক্রিয়া

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জেরে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয় সাংবাদিককে

চট্টগ্রামে জমি সংক্রান্ত একটি মামলায় জাতীয় দৈনিক দেশ বর্তমানে কর্মরত একজন সাংবাদিককে আসামি করায় শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। মামলা দায়েরের দেড় বছর পর হঠাৎ সক্রিয় হওয়া ‘গোপন মামলার’ নেপথ্যে সাংবাদিক জিয়াউল হক ইমনকে আসামি করার ঘটনা সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত কি না, তা নিয়ে উঠেছে জোরালো প্রশ্ন।

সাংবাদিক ইমন ২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক দেশ বর্তমানে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিল “কাল্পনিক মামলায় হয়রানি বাড়ছে চট্টগ্রাম আদালতে”। উপশিরোনামে ছিল “জালিয়াতিতে জড়িত আইনজীবীদের একটি চক্র”। প্রতিবেদনটিতে চট্টগ্রামের আদালতভিত্তিক জাল মামলার প্রবণতা, চক্র ও হয়রানির নানা দিক তুলে ধরা হয়। আশ্চর্যের বিষয়, ওই প্রতিবেদনে বর্তমান মামলার বাদীদের নাম উল্লেখই ছিল না। তারপরও এর এক বছর পর একটি জমি সংক্রান্ত মামলায় তার নাম ২ নম্বর আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রতিশোধের বার্তা নয় তো?

চট্টগ্রামের অনেক সিনিয়র সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর মতে, সাংবাদিক ইমনকে মামলায় জড়িয়ে পাঠানো হয়েছে একটি অদৃশ্য বার্তা এটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রতিশোধ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এক প্রবীণ আইনজীবী বলেন, “একজন সাংবাদিক যদি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে মামলায় জড়িয়ে পড়েন, সেটি স্পষ্টতই প্রতিশোধমূলক আচরণ।”

মামলার তথ্য ও বিতর্ক

২০২৪ সালের ৫ জুন মামলাটি দায়ের করেন নুরুল ইসলাম ও আলিমুল এহছান রাসেল। মামলার প্রধান আসামি আলাউদ্দিন, পরে সাংবাদিক ইমনসহ আরও দুজনকে যুক্ত করা হয়। চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো মামলা দায়েরের পর দেড় বছর ধরে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আদালতের একাধিক আদেশে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হলেও বাদী বা পুলিশ কেউ সাড়া দেননি। এরপর হঠাৎ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মামলাটি ‘সক্রিয়’ হয়ে ওঠে।

আরও একটি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলো ঘটনার এলাকা কোতোয়ালী বা বায়েজিদ থানার আওতাধীন হলেও তদন্তভার দেওয়া হয় ডবলমুরিং থানাকে। যদিও শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থল ডবলমুরিং এলাকা দেখানো হয়েছে।

জমির মালিকানা ও কাগজপত্র

প্রকৃত মালিক হিসেবে নিজেকে দাবি করা আলাউদ্দিনের হাতে রয়েছে অনলাইন খাজনা পরিশোধের কাগজ, নামজারি, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের বহুতল ভবনের অনুমোদনপত্র এবং পরপর তিনজন এসি (ভূমি) কর্মকর্তার লিখিত প্রতিবেদন।এর ফলে আগের একটি মামলা (নং-২০৬/২০২১) ইতিমধ্যে খারিজ হয়েছে। অর্থাৎ, জমির মালিকানা নিয়ে আপাতত সরকারি বা বিচারিকভাবে কোনো বিতর্ক নেই।

বাদী পক্ষের অস্পষ্টতা

বাদী নুরুল ইসলামের বক্তব্য আরও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন, “মামলার মূল উদ্যোক্তা রাসেল। আমি তেমন কিছু জানি না। আমার নাম শুধু দেওয়া হয়েছে।” যদিও তিনি মামলার ১নং বাদী। সাংবাদিককে জড়ানো এবং মামলার নানা অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি আইনজ্ঞ নই। একটি মামলা করতে গেলে অনেক কিছু লিখতে হয়।”

অপর বাদী রাসেল অবশ্য বলেন, “আমি ভুল কিছু করিনি। আরও মামলা সামনে আসবে।”

তবে মামলার অভিযোগে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যেমন ব্যাংকার আব্দুর রশিদ বা ব্যবসায়ী কফিল উদ্দিন তারা কেউই মামলার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি। এমনকি ব্যাংকার আব্দুর রশিদ বলেন, “আমি বাদীদের চিনি না।” তাদের বক্তব্য, “আলাউদ্দিনকে নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।”

সাংবাদিকের কণ্ঠ

সাংবাদিক জিয়াউল হক ইমন বলেন,

“আমি তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন করেছি তা কোনো মামলার বাদীদের বিরুদ্ধে নয়। তারপরও আমাকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এটি শুধু আমার নয়, পুরো সাংবাদিক সমাজের বিরুদ্ধে একটি বার্তা।”

তিনি আরও বলেন,

“প্রতিশোধমূলক এ মামলার পেছনে এক চিহ্নিত আইনজীবী ও জমি সিন্ডিকেটে জড়িতরা রয়েছে। আমি সম্প্রতি তাদের নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছি। সেটি জানার পর দীর্ঘ দেড় বছর আগে করা ‘গোপন’ মামলা সচল করে আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্রকারীর অন্যায়-অবিচার তুলে ধরতে আমি পিছপা হবো না।”

আইনজীবীদের সতর্ক বার্তা

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন,

“যে কেউ হয়রানিমূলক বা মিথ্যা মামলা করলে, সেটি আদালতে প্রমাণ হবে। আদালতে এসব মিথ্যা মামলা প্রতিহত করার সুযোগ রয়েছে।”

পুলিশের ভাষ্য

সিএমপি পশ্চিম বিভাগের উপ–কমিশনার হোসাইন মোহাম্মদ কবির ভূঁইয়া বলেন,

“মামলাটি এখন তদন্তাধীন। আমরা যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে আদালতে দ্রুত প্রতিবেদন দেব।”

আরও পড়ুন