২৩ অক্টোবর ২০২৫

শৃঙ্খলিত সংবাদপত্র মানে শৃঙ্খলিত সমাজ : কাদের গনি চৌধুরী

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, ‘শৃঙ্খলিত সংবাদপত্র মানে শৃঙ্খলিত সমাজ।’ মানবিক বাংলাদেশ গঠনে মুক্ত গণমাধ্যমের বিকল্প নেই। তাই সাংবাদিকতাকে বাধাহীন ও সত্যনিষ্ঠ হতে হবে।

শনিবার দুপুরে যশোর প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের সভাপতি আকরামুজ্জামান। সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ ও তৌহিদ জামান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে সমাজের বিবেকের স্বাধীনতা’

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “যে সমাজে মানুষ নিজের মনের কথা নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে পারে না, সে সমাজে বিবেক হারিয়ে যায়, মানবিক মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়।” তিনি আরও বলেন, একজন সাংবাদিকের কাজ হলো সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। তাই সাংবাদিককে হতে হবে সাহসী, সত্যনিষ্ঠ এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন।

তিনি বলেন, “একজন সাংবাদিক সবার আগে সত্যের কাছে, তারপর তার পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ। সততা, নির্ভুলতা ও পক্ষপাতহীনতা এই তিনটি সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি।” সত্য যাচাইয়ে গুরুত্ব দিয়ে তিনি যোগ করেন, “সংবাদ প্রকাশের আগে প্রতিটি তথ্য বারবার খতিয়ে দেখতে হবে। কোনো তথ্য নিয়ে সন্দেহ থাকলে তা বাদ দিতে হবে ‘when in doubt, leave it out’।”

বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন ও মালিকপক্ষের প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। ফলে গণমানুষের পক্ষে নয়, বরং স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

তিনি বলেন, “জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও গণমাধ্যমের একটি অংশ জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর ফলেই অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ছাত্র-জনতার ক্ষোভের মুখে পড়ে।”

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “যারা পালিয়েছেন বা পদ হারিয়েছেন, তাদের নৈতিক দেউলিয়াত্বই এর মূল কারণ। অনেকে মালিকপক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গিয়ে নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন, আবার অনেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন।”

তবে তিনি বলেন, মুদ্রার অপর পিঠে নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের অনন্য দৃষ্টান্তও রয়েছে যারা অভাব-অনটনের মধ্যেও সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন, তারাই প্রকৃত সাংবাদিক।

বিএফইউজে মহাসচিব জানান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের উদ্যোগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা গেছে

৭৯.৪৬% মানুষ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন, ৭১.৫০% সরকারি হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন, ৫০.১৪% প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। এ ছাড়া ৩১.৩৬% মানুষ মনে করেন সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ, ২৪.১৭% মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ, এবং ১২.৪৫% বিজ্ঞাপনদাতার চাপও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করছে।

একটি সমন্বিত জাতীয় গণমাধ্যম নীতিমালার দাবি

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, দেশে গণমাধ্যমের জন্য বর্তমানে প্রায় ৫০টি আইন, নীতিমালা ও বিধিবিধান আছে যা বিশ্বের কোথাও নেই। তিনি বলেন, “একাধিক নীতিমালা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত জাতীয় গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। এতে সব মাধ্যম সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “গণমাধ্যম থেকে যদি ‘গণ’ উধাও হয়ে যায়, তবে সেটি কেবল প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়। সাংবাদিকের কাজ হলো ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, প্রান্তিক মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো।”

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম বলেন, “যারা সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন, তাদের পালাতে হয়নি। যারা দলদাসে পরিণত হয়েছিলেন, তারাই পালিয়েছেন।”

বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন বলেন, সাংবাদিকদের আইনি সুরক্ষা দিলেও চাকরির নিরাপত্তা এখনও নিশ্চিত নয়। বেশিরভাগ গণমাধ্যম ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন দেয় না, অনেকে বেতন ছাড়াই কাজ করেন যা অত্যন্ত অন্যায্য।

এছাড়া যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি এড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আনিসুজ্জামান, প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুনসহ অন্য বক্তারাও সাংবাদিকদের অধিকার ও পেশাগত মর্যাদা রক্ষার আহ্বান জানান।

বক্তৃতার শেষাংশে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়, এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোই একজন সাংবাদিকের আসল শক্তি।”

আরও পড়ুন