রাত নামলেই কর্ণফুলী উপজেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে বালু উত্তোলন ও বিক্রির একাধিক সেলস সেন্টার। দিনের আলোয় তুলনামূলক নীরব থাকলেও অন্ধকার নামার পর এসব বালুমহালের তৎপরতা বাড়তে দেখা যায়।
স্থানীয়দের ভাষায়, পুরো পরিস্থিতি যেন এক ধরনের ‘লুকোচুরি’র মধ্য দিয়ে চলছে। এ নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ, কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই প্রশাসনের।
স্থানীয় সূত্র জানায়, একাধিকবার বিষয়টি কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তথা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করা হলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা ও সংশয়ের জন্ম নিচ্ছে।
কর্ণফুলীর ভেল্লাপাড়া ব্রিজের এপারে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুই পাশ দখল করে প্রায় ১০টি স্থানে বালুর ব্যবসা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়কের ওপর বালুর স্তর জমে থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রী ও যানবাহন চালকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় সংঘটিত কয়েকটি সহিংস ঘটনার পেছনে বালুমহালকে কেন্দ্র করে প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের শুরুতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে মহানগর এলাকায় অবৈধ বালুমহাল ও সেলস সেন্টার বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কর্ণফুলী উপজেলাও সিএমপি মেট্রোপলিটন এলাকার আওতাভুক্ত হলেও এখানে অবৈধ বালু ব্যবসা কার্যত অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, শাহ আমানত তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর দক্ষিণ পাশের কথিত নতুন ব্রিজের নিচে এবং উপজেলা সংলগ্ন ভেল্লাপাড়া ব্রিজ এলাকার সড়কের দুই পাশে একাধিক বালুর স্তূপ গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এসব কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকলেও পরে আবার চালু হয়।
দীর্ঘদিন ধরে ভেল্লাপাড়া সড়কের পাশের জায়গা দখল করে প্রভাবশালী একটি মহল বালুর ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে বালু এনে সেখানে স্তূপ করে রেখে পর্যায়ক্রমে বিক্রি করা হচ্ছে।
স্থানীয়ভাবে আলোচিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে সেভেন স্টার এন্টারপ্রাইজ, মনছুর এন্টারপ্রাইজ, বকুল এন্টারপ্রাইজ, নূর আলম এন্টারপ্রাইজ, তৌহিদ এন্টারপ্রাইজ, এলবি এন্টারপ্রাইজ, ফতেহ আলী শাহ এন্টারপ্রাইজ ও সরওয়ার করপোরেশন। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম, মালিকানা ও বৈধতার বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রভাবশালীদের কারণে তথ্য সংগ্রহ করাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
স্থানীয়দের একটি অংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিন্নতা থাকলেও বালু ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে প্রশাসনিক তদারকি দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে তাদের ধারণা।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেওয়া ট্রেড লাইসেন্সের মাধ্যমে এসব বালু ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সরকারি চোখের সামনেই এসব কার্যক্রম চললেও পরিবেশগত ঝুঁকি নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বালু উত্তোলন ও পরিবহনের কারণে ভেল্লাপাড়া ব্রিজের বিভিন্ন অংশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পাশাপাশি খালে ড্রেজারের পাইপ বসিয়ে বালু উত্তোলনের অভিযোগও রয়েছে, যা খাস জমি ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কর্ণফুলীর বাসিন্দা জসিম উদ্দিন জুয়েল বলেন, বালু ব্যবসার বিষয়টি মূলত জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত। উপজেলা প্রশাসন চাইলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অনুমোদন ও বৈধতা যাচাই করতে পারে। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগত জায়গায় ব্যবসা হলেও পরিবেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। আর অবৈধ কার্যক্রম দ্রুত উচ্ছেদ করা জরুরি।
কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘বালুমহালের বিষয়ে আমাদের সবসময় নজর আছে। উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা পেলে যৌথ অভিযানের চেষ্টা করব।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক বেগম সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘আসলে বালুমহাল কিংবা সেলস সেন্টারের বিষয়ে আপনি ডিসি অফিস কিংবা সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ডের সাথে যোগাযোগ করলে ভালো হয়।’
কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল আমিন হোসেন বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে ইউএনও স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা হবে। তারপরও আপনি একটু স্যারের সাথে যোগাযোগ করেন।’
সেভেন স্টার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমরা নদী বা খাল থেকে বালু উত্তোলন করি না। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ভাড়া নিয়ে অন্য জায়গা হতে বালু সংগ্রহ করে মজুত করে বিক্রি করি মাত্র। আমরা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে ব্যবসা করি। কাগজপত্র সব রয়েছে আমাদের।’
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব কান্তি রুদ্র বলেন, ‘বালুর সেলস সেন্টারগুলোকে কাগজপত্র দেখাতে বলেছি। দ্রুত এ বিষয়ে সামনে এগোনো হবে।’













