বাংলাধারা ডেস্ক »
বন্ধুর আবার দিবস কী? এটা বলবে কেউ। আবার কেউ বলবে কেন বন্ধু দিবস না? বন্ধুর জন্য একটা দিন থাকতেই পারে। বন্ধু মানে ছেলে আর ছেলে মানে যারা সমবয়সী? না। সেটা না। অথবা দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের একত্রে যাপিত জীবনের গল্পটাই বন্ধুতা? একেবারে সেটাই যে, তাও না। তাহলে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা চাইলে অনেকেই তো বলবেন নির্দ্বিধায় ‘বাবা মায়ের সাথে সন্তানের, ভাই বোনের সাথে নিজেরাই, সহপাঠী কিংবা সমবয়সী অথবা এই বন্ধুত্ব কোনও বয়সই মানে না’। মূলত বন্ধুত্ব মানেই হচ্ছে সমস্ত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে একে অপরের জন্য নিজের মতোই সবকিছু পছন্দে-অপছন্দে রাখা, একে অপরের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এই যে একজন আরেকজনের বন্ধু। এই বন্ধুর নাম ফ্রেন্ড। বন্ধুর নাম বন্ধু। বন্ধুর নাম দোস্ত। কেউ কেউ প্রভাবিত ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে ইয়ার কিংবা অন্য কোনও শব্দেও অভ্যস্ত। এসবের কিছুই আসলে ধরার মধ্যে নেই। বন্ধু এমন এক অসীম বিষয়, যেখানে কে কাকে কী বলে ডাকছে, তার কিছুই গুরুত্বপূর্ণ না। আবার কে কাকে আপনি আপনি করছে কিংবা কে কাকে ডাকছে মিষ্টি মিষ্টি তুমি বলে অথবা একেবারে ভেসে গিয়ে তুই তুকারী, এসবের ক্ষেত্রে আসলে একটা সম্পর্কেই কোনও কিছু কোনও শিকলে বন্দি থাকে না। সেটা শুধুই বন্ধুত্বে। বন্ধুত্বে ডাক ও সম্বোধন একদম কিছু না, কিছু না মানে কিছুই না।
প্রাচীন রুপকথায় আছে বন্ধুত্বের কথা। সেই রুপকথায় আছে প্রকৃতির চন্দ্র ও সূর্যের নাকি বন্ধুত্ব ছিল খুব। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব নাকি স্থায়ী হয়নি। কারণ ওই একটাই, সেটা ক্ষমতার দাম্ভিকতা। সূর্য বলেছিল সে ছাড়া চাঁদ অন্ধকারে। চাঁদ ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল সূর্যের কেবল যে প্রখরতাই আছে, সেসব কথা। সূর্য নাকি রাগ করে একগাদা তপ্ত বালি ছুড়ে মারল চাঁদের মুখে। কালচে গভীর দাগ হয়ে গেল তার ফলে। সেগুলোই হচ্ছে চাঁদের কলঙ্ক। কোনোদিনই তা মুছে যাওয়ার নয়। এই যে সেই প্রাচীন কালের রূপকথা, এখানেও বন্ধুত্বের কথা জানা যায়। আবার মহাকাব্য ‘ইলিয়াডে’ মাইসিনির রাজা ও গ্রিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আগামেননের বন্ধু ও বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা ছিলেন নেলেউসের পুত্র ও পাইলসের রাজা নেস্টর। যিনি ট্রয় যুদ্ধে গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের সঙ্গে আগামেননের দ্বন্দ্ব ও ক্রোধ প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন প্রকৃত বন্ধুর মতো। অন্যদিকে টেলেমেকাসের পিতার ভালো বন্ধুর কথা আরেক মহাকাব্য ‘ওদিসি’তে পাওয়া যায়।
জানা যায় ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যেই আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস ধারণাটি ড: আর্টেমিও ব্র্যাচো প্রস্তাব করেন ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই। বন্ধুত্ব দিবস বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে পালন করা হয় প্রথম বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস ৩০ জুলাই করার জন্য প্রস্তাবিত হয়ে ছিল ১৯৫৮ সালে। ২৭ এপ্রিল ২০১১ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাইকে অফিসিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ ডে ঘোষিত হয়। তবে বাংলাদেশ ও ভারতসহ কিছু দেশে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধুত্ব দিবস উদযাপন করে। তবে ঘাঁটাঘাঁটি করলে আসে এটাই – বন্ধু দিবস হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা “জয়েস হল” দ্বারা উন্নীত হয়েছিল ১৯১৯ সালে এবং আগস্টের প্রথম রবিবার বন্ধুত্ব দিবস এবং এই দিন সবাই একে অন্যেকে কার্ড পাঠাত।
এই বন্ধু দিবস কেন পালিত হয়? যেন বন্ধু বুঝতে পারে বন্ধুর গুরুত্ব। বন্ধুর বাইরেও যেন অন্য সকলে ব্যাপারটা সম্পর্কে বুঝতে পারে এবং নিজেরাও বিভিন্ন স্তরে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পারে। কথায় আছে বিশ্বাস ভালোবাসার শক্তি। আর বন্ধুত্বে বিশ্বাস রক্ষা করা খুবই জরুরি। তৃতীয় কোনো পক্ষের কথার সূত্র ধরে বন্ধুত্বের বিশ্বাসভঙ্গ কখনোই কাম্য নয়। প্রকৃত বন্ধুকে এ বিষয়টি সবসময় মাথায় রাখতে হয়, তবেই তো প্রকৃত বন্ধুত্ব হয়। এক বন্ধুর বিপদে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অন্য বন্ধুর সাড়া দেওয়াই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয়। প্রয়োজনে সময়ে অসময়ে বন্ধুর বিপদে তাকে সাহায্য করা। যে বন্ধুর জন্য আপনি এমন করতে পারবেন এবং যে বন্ধু আপনার পাশে সর্বদা থাকতে পারবে, সে-ই আপনার সত্যিকার বন্ধু।
বন্ধুর ইচ্ছাকে সবসময় সম্মান জানানো উচিত। যদি তা পছন্দ না হয়, তবে সরাসরি বলুন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা অবশ্যই জরুরি। সমালোচনা করুন, তবে কটুক্তি নয়। তবে সমালোচনার ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়ায় খুবই প্রয়োজন। একবার ভুল হলে তাকে ছুঁড়ে না ফেলে তা শুধরে নেওয়াই প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। বন্ধুর প্রতি বিনয়ী হওয়া বন্ধুত্বের প্রধান হাতিয়ার। ভালো বন্ধু সবসময় বন্ধুর ভালো চায়। নিজের ভালো হোক সকলেই চায়, তবে তার জন্য বন্ধুর ক্ষতি হোক এমন ভাবা কিন্তু প্রকৃত বন্ধুর পরিচায়ক নয়। প্রকৃত বন্ধু চাইবেন তার নিজের উন্নতির পাশাপাশি আপনারও উন্নতি হোক। যেখানে কিংবা যত দূরেই থাকুন না কেন, বন্ধুর কল্যাণ কামনাই প্রিয় বন্ধুর পরিচায়ক।
বন্ধুত্বে অবশ্যই সৎ থাকতে হবে। মিথ্যা তথ্য কিংবা ধারণা দিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়া যায়, কিন্তু গড়লেও তা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আপনি যা সেটাই প্রকাশ করা এবং অযথা কৃত্রিমতা বর্জন করে নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বন্ধুর কাছে স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরাই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। মনের মতো বন্ধু পেতে সততার কোনো বিকল্প নেই। সততা প্রিজারভেটিভ ছাড়াই সম্পর্কের বৃক্ষকে সতেজ রাখে। দীর্ঘদিনের বন্ধুরা একে অন্যের পেছনে সময় ব্যয় করে। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। বন্ধুরা হয়তো আগের মতো সময় দিতে পারে না। এর ফলে যে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের ব্যাঘাত ঘটবে তা কিন্তু না। নতুন বন্ধুদের পাশাপাশি পুরোনো সম্পর্কগুলোকে ঝালাই করে নিতে হয় প্রতিনিয়ত। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় পুরোনো বন্ধুত্বকে হারিয়ে ফেলা একদমই উচিত নয়। আপনার বন্ধু আর আপনার মাঝখানে কেবল এক মুঠোফোন দূরত্ব।
বন্ধুকে মনে করুন, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করুন। বন্ধুত্বে ভালো শ্রোতা হওয়াও খুব জরুরি। বন্ধুর সাথে আড্ডায় কেবল নিজের কথাগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। বন্ধুকেও কথা বলতে দেওয়া এবং আলোচনায় উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে দুজনের ভালো লাগা, মন্দ লাগা পরষ্পরের বুঝে নিতে সহজ হয়। বন্ধুর সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, বন্ধুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয় নিয়ে উপহাস না করাই প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। বন্ধু মানেই কেবল আমার সবটুকু কথা তাকে বলে ফেলা নয়, বরং তার কথাগুলোকেও আপন করে নেওয়া।
বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা অনেক কঠিন কাজ। তবে একজন প্রকৃত বন্ধু সব সময়ই সম্পর্ককে প্রাধান্য দেন। তবে অনেকেই জানে না যে বন্ধুত্ব কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়। ফলে কারণে-অকারণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়, দূরত্ব তৈরি হয়, বন্ধুত্ব ক্রমেই হারিয়ে যায়। বিপরীতে যারা দীর্ঘদিন বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে চান তাদের থাকতে হবে স্বাভাবিকতা আর প্রাণ চাঞ্চল্য। বন্ধুত্বের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, রাগ, অনুরাগ, ব্যস্ততা, এড়িয়ে চলা, নার্ভাস ভাব ইত্যাদি দূরে রাখা শিখতে হয়।
কালের স্রোতে আজকাল বন্ধুত্বও তো বদলে যাচ্ছে ৷ স্কুল, কলেজ, অফিস, পাড়ায় আটকে থাকছে না আর এই সম্পর্কটি ৷ এর পরিধি বেড়ে চলেছে স্যোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে৷ যদিও হাজার পেরিয়ে লক্ষ ছাড়িয়ে এমন অগনিত বন্ধুদের কতটা সত্যি চেনা হয়, মনে রাখা হয় এবং পাশে পাওয়া যায় তা বলা কঠিন ৷ মানুষে-মানুষে ,দেশে-দেশে, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বন্ধুত্বের বদল তো আর কারও অজানা নয় ৷ যা দেখে প্রশ্ন উঠছে বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই এই যা আছে তা আসলে সম্পর্কের সমীকরণ মাত্র৷
বাংলাধারা/এফএস/এমআর/টিএম













