৪ নভেম্বর ২০২৫

নাছিরের কাল হতে পারে ‘স্বপ্নের মেগাসিটি’ ইশতেহার

বাংলাধারা প্রতিবেদন »

‘স্বপ্নের মেগাসিটি গড়তে চাই, জলাবদ্ধতামুক্ত জনবান্ধব চট্টগ্রাম’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৫ সালের চসিক নির্বাচনে ৩৭ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। কিন্তু তার দেয়া প্রতিশ্রুতির সিংহভাগই অপূর্ণ তো থেকেই গেল বরং উল্টো নানা সময়ে সমালোচিত হয়েছেন প্রতিশ্রুতির বিপরীমুখী কাজের জন্য।

জলাবদ্ধতা নিরসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ইশতেহারে সেবাধর্মী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় নগরবাসীর কাছে নাছিরের পক্ষে ভোট চেয়েছিলেন তৎকালীন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীও।

আ জ ম নাছিরের ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল- জলাবদ্ধতা দূরীকরণে খাল ও নালাগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, নতুন খাল খনন, নগরীর আবর্জনা পরিষ্কারে পৃথক বোর্ড গঠন, কর্ণফুলী নদীর মুখে স্লুইস গেইট নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর খনন ও ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রণীত মাস্টার প্ল্যান যুগোপযুগি করে বাস্তবায়ন করা।

নগরীকে ওয়াইফাই জোনের আওতায় আনার ঘোষণা ছাড়াও ওই ইশতেহারে পাহাড় রক্ষা ও বনায়ন, পানি দূষণ রোধ, পানি সংকট নিরসন, কর্ণফুলী নদী রক্ষা করা, শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, তথ্য প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থীদের বাসভাড়ায় ভর্তুকি, নারীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু, আবাসন সংকট নিরসন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ক্রীড়া ও বিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠন, সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ, গণশৌচাগারের উন্নয়ন, ভিক্ষাবৃত্তি বিমোচন, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা, প্রান্তিক মানুষের সুবিধা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট নিরসন, ফরমালিনমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা, আধুনিক কসাইখানা স্থাপন, গরীব মানুষের জন্য বহুতল ফ্ল্যাট, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আধুনিক করা, শিশুবান্ধব নগর, ধর্মীয় সুবিধা প্রদান, তরুণ-যুবা-নারী সমাজকে কর্মমুখী করা, কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান, ল্যাবরেটরি স্থাপন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল।

নাছিরের দেয়া সেই প্রতিশ্রুতির সিংহভাগই পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্লেষক মহলে চলছে নানা হিসাব নিকাশ। এবারের মনোনয়ন দৌড়ে নাছিরের পিছিয়ে পড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন এ বিশ্লেষক মহ। বিশ্লেষকদের মতামতে যা উঠে এসেছে-

১. গত ৫ বছরে সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ এবং দুদকের নজরদারি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগও আলোচনায় আছে খুব জোরেসুরে। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচনায় নিতে পারেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।

২. জলাবদ্ধতা নিরসনকে প্রধান দায়িত্ব হিসেবে নিলেও সেই কাজে কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি নাছির বরং জলাবদ্ধতার বিষয়ে কাজ করার নিয়ন্ত্রণ খুইয়েছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে। বিশেষ এ প্রকল্প সরকার থেকে অনুমোদন আনতেও ব্যর্থ হন মেয়র তিনি। চট্টগ্রামের এ প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে বাদ দিয়ে সিডিএকে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মেগা প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। নিজের নির্বাচনী প্রধান অঙ্গীকারের বিষয়ে কাজ করার ক্ষমতা হারানোকে মেয়রের একটি বড় ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন নগরবাসী। অন্যদিকে, সেবা সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়িও চরম ভোগান্তিতে ফেলছে। এর সঙ্গে আছে ক্ষতবিক্ষত সড়ক, মহাসড়ক ও উপসড়কগুলো। আছে অবৈধ রিকশার যন্ত্রণা, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করে ময়লা যথাসময়ে অপসারণ না করা।

৩. গণমাধ্যমে ইদানিংকাল সবচেয়ে বেশি খবরগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী নদী রক্ষা আন্দোলন নিয়ে। যে আন্দোলনে স্বতস্ফূর্তভাতে যোগ দিয়েছে নগরবাসী। এ নদী রক্ষা করার জন্য নানা উদ্যোগের কথা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিলেন বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। কিন্তু এ পাঁচ বছরে প্রতিশ্রুতি পালনে কোন লক্ষাণই দেখা যায়নি। দেখা গেছে কর্ণফুলী বাঁচাতে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও সিটি কর্পোরেশনের তেমন কোন উদ্যোগের দেখা মেলেনি।

৪. মেয়র ও দলের শীর্ষ পদে চট্টগ্রাম বন্দরসহ ব্যক্তিগত কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকায় সিটি করপোরেশনের কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে বলে মনে করেন অনেকেই। এই দীর্ঘ সময়ে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সভাপতি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সহ-সভাপতিসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের দায়িত্বেও ছিলেন মেয়র নাছির। এক সাথে এতসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সিটি কর্পোরেশন মেয়রের মূল দায়িত্বে বলার মত সফলতা দেখাতে পারেননি তিনি- এমনটাই মনে করছেন অনেকে।

৫. ইশতেহারে প্রথম সারিতে থাকা নগরীজুড়ে ওয়াইফাই জোনের কোন হদিস নেই। নির্বাচিত হওয়ার পর আদালত ভবন এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজকে (চমেক) ওয়াইফাই’র জোন ঘোষণা করলেও তা বেশি দিন সচল থাকেনি। এছাড়া ওয়াইফাই জোন নিয়ে আর কোন পরিকল্পনাও দেখা যায়নি নাছিরের।

৬. চট্টগ্রামের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ সিটির মেয়রদেরকেও প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলেও আ জ ম নাছিরের মুকুট ছিল শূন্য। ঢাকার পরেই গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অবস্থান হলেও মেয়র নাছিরকে ধারাবাহিকভাবে পদমর্যাদার বাইরে রেখে দেওয়ার বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি তার ওপর নেই। এ কারণে গত অন্তত ৫ বছরে চট্টগ্রামভিত্তিক উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রায় সবই সিটি কর্পোরেশনকে না দিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টিকে বড় করে দেখছেন তারা।

৭. মেয়র নাছিরের ৫ বছরে চসিকের স্বাস্থ্যসেবা ছিল শূন্যের কোটায়। তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রতি ওয়ার্ডে এক হাজার পরিবারকে ‘মেয়র হেলথ কার্ড’ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের সফলতা খুব একটা দেখা যায়নি। সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার আমলে প্রতিটি ওয়ার্ডে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হলেও পরবর্তী মেয়র ও আ জ ম নছিরও সে সুনাম ধরে রাখতে পারেননি।

৮. নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নির্মাণকাজে দীর্ঘসূত্রতা ও এসব কাজ শেষ করতে না পারার ব্যর্থতাও ডোবাতে পারে মেয়র নাছিরকে। চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান দুটি সড়ক পোর্ট কানেকটিং রোড ও আগ্রাবাদ এক্সেস রোড। ২০১৭ সালের শেষের দিকে এই দুটি সড়কের কাজ শুরু করে চসিক। ২০১৭ সালের ১২ মার্চ চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শুধু চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সড়কের অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ নগরীর এ দুরবস্থা আমি দেখতে চাই না। কার গাফিলতিতে এ দুরবস্থা তা জানতে চাই। আপনারা ডিপিপি প্রণয়ন করুন। একনেকে পাঠান, একনেকে তো আমি সভাপতিত্ব করি, আমি অনুমোদন দেব। কিন্তু কাজ হবে না তা সহ্য করব না।’ এই বিষয়টিও শেষ পর্যন্ত মেয়র নাছিরকে অস্বস্তিতে রাখবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

৯. বর্তমান সিটি মেয়র আ জম নাছির উদ্দীন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত ৮৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত ৫ বছরে শিক্ষাব্যয় বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ৬০ হাজার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। দেখা গেছে এ পাঁচ বছরে এসব স্কুলে বেতন ফিসহ অন্যান্য অনিয়ম নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলনও করেছে বিভিন্ন সময়।

১০. নির্বাচনী ইশতাহের পাহাড় রক্ষা ও বনায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আ জ ম নাছির। তিনি নির্বাচিত হলেও গত ৫ বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগ ছিল খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিরুদ্ধেও। প্রকাশ্যে নির্বিচারে পাহাড় কেটে লেক সিটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

এছাড়াও ২০১৫ সালে আ জ ম নাছিরের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির যেসব পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বাসভাড়ায় ভর্তুকি, শিশু ও খেলাধুলার উপযোগী নগরীর গড়া পানি দূষণ রোধ, পানি সংকট নিরসন, নারীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু, আবাসন সংকট নিরসন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠন, সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ, ভিক্ষাবৃত্তি বিমোচন, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা, প্রান্তিক মানুষের সুবিধা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট নিরসন, ফরমালিনমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা, তরুণ-যুবা-নারী সমাজকে কর্মমুখী করা, কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান, ল্যাবরেটরি স্থাপন, নগর ভবনে বিল প্রদানে স্মার্ট কার্ড স্কিম বাস্তবায়ন।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ