তারেক মাহমুদ »
করোনাভাইরাস মহামারী সংক্রমণের ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রায় ঝুঁকিতে আছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অবশ্য স্বাস্থ্য বিভাগ এখন থেকে সমন্বিত উপায়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্যোগ নিয়েছে। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের সঠিক পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রস্তুতি। ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশনস ডিজিজ (বিটিআইডি) হাসপাতালে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা হবে। তবে এরজন্য প্রয়োজনীয় শণাক্তকরণ কিট এখনো চট্টগ্রামে এসে পৌঁছায় নি।
অন্যদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রবাসীদের একটি বৃহৎ অংশ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। এই বিদেশফেরত ব্যক্তিদের নিয়েই যত মাথাব্যথা। কেননা ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় অনেকেই দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। যাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের। যাদের অধিকাংশই হোম বা স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম মেনে চলছেন না। এমনকি গ্রামে ও নগরীর এখানে সেখানে আগেই এসে ছড়িয়ে পড়া প্রবাসীরা নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও যত্রতত্র মিশছেন সকলের সাথে।
এদের নিয়েই এখন চরম বিপত্তি। যা রীতিমতো শঙ্কা তৈরি করছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তা ফাঁকি দিয়ে উধাও হয়ে চট্টগ্রামের রাউজান, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, মীরসরাই, সীতাকুন্ড, বোয়ালখালী, বাঁশখালী উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান পর্যন্ত করা হচ্ছে। গত শুক্রবার এসব এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন। মীরসরাই উপজেলার বারৈয়ার হাটে এক বৌভাত অনুষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে সদ্য ওমান ফেরত বর-কনেকে ধরে নেয়া হয় কোয়ারেন্টাইনে। অর্থদন্ডও করা হয়।
নগরীর চকবাজার এলাকার গতকাল দুপুরের এক ঘটনায় সৃষ্টি হয় ভীতি ও চাঞ্চল্য। একটি বহুতল ভবনের ৮ম তলায় সদ্য ইতালী ফেরত এক প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইনে ফাঁকি দিয়ে থাকছে। অবাধে ঘুরছে। তা জানাজানি হলে ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে ভীতি-শঙ্কা তৈরি হয়। জানানো হয় প্রশাসনকে। তবে পুলিশ আসার আগেই ইতালি ফেরত ব্যক্তিটি অন্যত্র কেটে পড়েন।

বিদেশ ফেরতরা বাজার-ঘাটে ঘুরছেন। কেননা কারও হাতে পড়েনি কোয়ারেন্টাইনের সিল। যা এখন বিমান বন্দরে আসামাত্র দেয়া হচ্ছে। তবে পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থা গত শুক্রবার থেকে চট্টগ্রামে প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন ফাঁকি বা লংঘন এবং বিচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুটা জনসচেতনতাও তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রামে গত ২২ মার্চ ২৪ ঘণ্টায় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে আরো ৮৫৭ জন প্রবাসী দেশে ফিরেন। প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ ওদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, কয়েকদিন আগে বিদেশ ফেরতদের মধ্যে ২৩৭ জন আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। প্রবাসীদের নাম-ঠিকানা, ফোন নাম্বারসহ বৃত্তান্ত উপজেলা বা থানা প্রশাসকে দেয়া হয়েছে। চলছে স্থানীয় প্রশাসনের মনিটরিং। তবে করোনাভাইরাস আক্রান্ত অবস্থায় কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে সবরকম কোয়ারেন্টাইনে সতর্কতা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য বিভাগ তা সমন্বয় করছে। বন্দর হাসপাতালে ৫০ শয্যার একটি স্বতন্ত্র ইউনিট, বন্দরের জেটিতে সী-অ্যাম্বুলেন্স এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। বিদেশ থেকে আগত যে কোনো জাহাজ বন্দরে ঢোকার আগে সমুদ্রে অপেক্ষা করছে। দিতে হচ্ছে কারোনামুক্ত থাকার বিষয়ে নাবিকদের স্বাস্থ্যগত বিবরণ। কোয়ারেন্টাইনে সমুদ্রের দিকেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চীনের কোনো সমুদ্র বন্দর হয়ে আসা জাহাজকে। জেটিতে ভিড়ার আগে নাবিকেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ছাড়পত্র পাওয়া সাপেক্ষেই চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে বিদেশি ও দেশি নাবিকদের।

সমুদ্র বন্দর হয়ে আসা বিদেশী জাহাজের নাবিকদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের উচ্চঝুঁকির শঙ্কা ও গুরুত্ব বিবেচনায় রেখেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আগাম এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। যাতে কোন নাবিকের মাধ্যমে সংক্রমণ বিপত্তি না ঘটে। তাছাড়া বন্দর-পতেঙ্গায় প্রবাসীদের বিদেশ ফেরা সম্পর্কেও সতর্ক দৃষ্টি এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। এলাকাবাসীও আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন।
কার্যত বহির্বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এ বিমানবন্দর। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্য, তুর্কি, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ নির্ধারিত কিছু দেশের কোন ফ্লাইট দেশের কোনো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে না। তাছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাগুলোর অবস্থা এবং কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অবস্থানরত বিদেশিদের গতিবিধি মনিটরিং করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানো নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন আরও ছয়জন। এ নিয়ে অচেনা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে মোট চারজনের মৃত্যু হলো। এছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৩৯ জনে।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম













