২৫ অক্টোবর ২০২৫

করোনাকথন ও দেলোয়ার-জগদীশের গল্প

ফারহানা জাহান উপমা »

রোজার মাঝামাঝি। ইফতার মাত্র শেষ। ফোন এসেছে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী মারা গিয়েছেন। তাঁর কোন পুত্র সন্তান নেই। তাঁর কন্যাদের আবেদন পিতার নির্বিঘ্ন সৎকার যেন হয়। দেলোয়ার ও অফিসের একজন সহকর্মীসহ সেই সৎকার-এ উপস্থিত থেকে দায়িত্ব সম্পাদন।

এরপর… ২৪/২৫ তম রোজা হবে হয়তো। সেহেরি খেয়ে সবাই ঘুমের রাজ্যে প্রায়। ফোন-এ খবর আসলো সবুর রোডসহ আশেপাশের এলাকায় কিছু দোকান খোলা হয়েছে। লোকসমাগম। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে আমার সরকারি গাড়ির চালক দেলোয়ারকে ফোন দেই। তিন চার রিং এই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে দেলোয়ার ফোন রিসিভ করেন। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই দেলোয়ারকে বলি, ‘দেলোয়ার, সবুর রোডে নাকি দোকান খোলা। যাবেন নাকি? একটু কষ্ট করে আসেন। আর দেখেন প্রিয়তোষকে পান কিনা।’

আমি ফোন দেয়ার মিনিট দশেকের মধ্যেই দেলোয়ার পুরোদস্তুর রেডি হয়ে প্রিয়তোষসহ গাড়ি নিয়ে হাজির। চোখেমুখে কোন বিরক্তি/ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। আমি কি অবাক হয়েছিলাম! সত্যিই মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। এরপর এলো চাঁদরাত। জরুরি কাজে আবার সেই মাঝরাতে দেলোয়ারকে ফোন দেয়ার মিনিট দশেকের মধ্যে রেডি হয়ে হাজির আমরা, যেন দ্রুত জানাযায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে যেতে পারি। আমরা সেই ঈদের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত বাইরেই ছিলাম একটানা। সংগত কারণেই এই প্রচন্ড গরমে মাস্ক ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নিরাপত্তাসামগ্রী ব্যবহার করে দেলোয়ার অবিচলভাবে আমার সাথে দায়িত্বপালনে ছিলেন।

এভাবে সেই করোনার শুরু থেকে আজ অবধি আমার প্রতিটা কাজে অবিচ্ছেদ্যভাবে দেলোয়ার ছিলেন, সাথে কখনো কখনো এসিল্যান্ড অফিসের চালক সুজন অথবা উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়ের গাড়িচালক হেলাল তো আছেনই। আমরা মনে-প্রাণে চেয়েছি, চাই তারা সুস্থ থাকুক। তারপরও আজকের রিপোর্টে দেলোয়ারের পজিটিভ এসেছে।

করোনার শুরু থেকে বাংলো ও অফিসের নিরাপত্তায় ও সার্বিক তদারকিতে থাকা জগদীশ ও অন্যান্যদের কাজ কিছুটা বেড়েছিল বৈকি। জীবানুনাশক ছিটানো থেকে শুরু করে কতো কাজ। সেই জগদীশ আর বাবুল- এই দুই মানিকজোড় আবার আমার বাচ্চাদের খুব প্রিয়। দোতলা থেকে তাদের কণ্ঠ ভেসে আসতো ‘বাবুল আংকেল আর জগদীশ আংকেল’।

করোনাতে ঈদও আমাদের সাথেই করলেন তারা। আমাদের এই মানিকজোড়ের একজনের করোনা পজিটিভ। তাদের কোন উপসর্গ ছিল না। দুই তারিখ উপজেলা পরিষদ কোয়ার্টারে তাদের পার্শ্ববর্তী ভবনের একজনের করোনা পজিটিভ আসায় সন্দেহবশত তারা নমুনা দিয়েছিলেন, যদিও তারা করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের সরাসরি সংস্পর্শে আসেননি।

পরিসংখ্যান কর্মকর্তা : করোনার শুরু থেকেই আমি স্বল্প রিসোর্স ব্যবহারে বিশ্বাসী। তাই, প্রয়োজন না হলে অফিসে কাওকেই খুব একটা আসতে বলতাম না। সেই সময় একদিন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ফোন দিয়ে বললেন, ‘কোন কাজ থাকলে জানাবেন, দেশের জন্য কাজ করতে পারলে ভালো লাগবে।’

সেই শুরু। কন্ট্রোল রুমে ফোন পেয়ে মানবিক সহায়তা নিয়ে গিয়েছেন, ট্যাগ অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যদের সুরক্ষায় স্থানীয়ভাবে ফেসশিল্ড বানানোর উদ্যোগসহ কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন। যখন যে কাজে সহায়তা চেয়েছি, দৌড়ে এসেছেন।

উপজেলায় যে কাজই হোক, কী ওএমএস, কী অন্য কিছু, ট্যাগ অফিসার হিসেবে কমন ফ্যাক্টর পরিসংখ্যান কর্মকর্তা আর সমবায় কর্মকর্তাসহ আরো কয়েকজন। এর মাঝেই হঠাৎ খবর এলো পরিসংখ্যান কর্মকর্তা পজিটিভ। আমার বিশ্বাস হয়নি প্রথমে। হওয়ার কথাও না।

করোনায় এছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী, এর পর একে একে পুলিশ, আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য, মৎস্য অফিসারসহ আরো অনেকে। ঝুঁকি নিয়ে এখনো সতের ইউনিয়ন আর পৌরসভায় যতো ট্যাগ অফিসার আছেন, তারাসহ সরকারি প্রতিটি দপ্তরের মানুষ কাজ করছেন, পিআই ও অফিস, ফুড অফিস, কৃষি, পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, ব্যাংক, ট্রেজারি থেকে শুরু করে সকল অফিস কাজ করছেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকবৃন্দ, স্বেচ্ছাসেবক, গ্রাম পুলিশ, ইউপি সচিব, উদ্যোক্তা, ডাক্তার, বেসরকারি কর্মকর্তাসহ আমরা সকলেই একযোগে একটি লক্ষ্যেই কাজ করছি, যেন পটিয়াবাসী তথা দেশবাসী সুস্থ থাকেন। আমাদের সবার চেষ্টা বিফল হয়ে যায় যখন মাস্ক ছাড়া বিনা প্রয়োজনে লোকজন ঘুরে বেড়ান।

তাই আবারো বলছি, আপনারা মাস্ক পড়ুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। আর দোয়া করবেন, আমাদের দেলোয়ার, জগদীশসহ, সকল করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেন সুস্থভাবে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন।

সবশেষে, মাস্ক পড়ুন, নিজের জীবন বাঁচান, অন্যের জীবন বাঁচান।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পটিয়া, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন