মুহাম্মদ আব্দুল আলী »
মহামারি করোনাকালে আদালত পাড়ার শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা অসহায় হয়ে পড়েছে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েও তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। করোনার এই দুঃসময়ে বেকায়দায় পড়ে কষ্টে দিন যাপন করছেন তাঁরা। তারা মনে করছেন, সিনিয়র আইনজীবীরা পাশে দাঁড়ালে তাদের এমন পরিস্থিতি হতো না।
আদালত পাড়ায় সারা দিন মামলার নথি টানা, আদালতে মামলার আবেদন লেখা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে থেকে দিনভর সহযোগিতা করার পর বিনিময়ে দিন শেষে যাতায়াত খরচ হিসেবে কিছু পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন এইসব শিক্ষানবীশ আইনজীবী। আজ করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে যেন তাদের দেখার কেউ নেই।
এই করোনাকালে ভুলতে বসেছে আদালত পাড়ার এই বড় অংশ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কথা। তাদের কথা ভাবনার যেন কেউ নেই। অমানবিকতা আর অবহেলাই যেন তাদের নিয়তি। দেশের সমস্ত বারগুলো তার সদস্যদের সংকটে যখন কম বেশি এগিয়ে এসেছে তখন কেউ সহমর্মিতা দেখাচ্ছে না এই শিক্ষানবিশদের প্রতি।
জানা যায়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পরীক্ষা দিতে হয়। তার আগে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। বাধ্যতামূলকভাবে জ্যেষ্ঠ কোনো আইনজীবীর সঙ্গে শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করতে হয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর এই শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা পড়েছেন দুর্ভোগে। আদালত বন্ধ। কাজ নেই, তো পয়সাও নেই। দেশে এমন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর সংখ্যা এখন ৬৫ হাজারেরও বেশি।
চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুবই আর্থিক সমস্যার মধ্যে আছেন তারা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরে যাদের বাড়ি নেই, ভাড়া বাসায় থাকতে হয়, তারাই বেশি সমস্যায় পড়েছেন। তাঁরা যেহেতু কোনো আইনজীবী সমিতির সদস্য নন, এ কারণে সেখান থেকেও কোনো সহযোগিতা পাবেন না। খুবই দুঃচিন্তায় আছেন তারা। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও চলছে আলোচনা সমালোচনা।
চট্টগ্রাম আদালতের শিক্ষানবিশ আইনজীবী আরিফুল ইসলাম বলেন, এই মহামারিতে অনেক সিনিয়ররা মানবিক দিক চিন্তা করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের অধীনে করছে এমন শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সহযোগিতা করছে। তবে তা খুবই কম। সিংহভাগ শিক্ষানবিশ চরম কষ্টে দিনযাপন করছেন। পাচ্ছে না কোন সহযোগিতা। এমন কি কোর্ট চলাকালীন সময়েও বেশিরভাগ সিনিয়রা শিক্ষানবিশদের পারিশ্রমিকও ঠিকমতো দিত না। সব মিলে এই করোনায় শিক্ষানবিশরাই সবচেয়ে কষ্টে আছে। সামনে কতদিন বন্ধ থাকে আদালত তা তারা নিয়ে চিন্তায় আছেন বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম আদালতের শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আরেকজন বলেন, কোর্ট খোলা থাকা অবস্থায় আদালতে সিনিয়র আইনজীবীকে সহযোগিতা করে এসেছি প্রতিদিন। এর বিনিময়ে সামান্য পারিশ্রমিকও পেতাম। তা দিয়ে মোটামুটি বাসাভাড়াসহ প্রতিদিন যাতায়াত ও খাওয়া-দাওয়ার খরচ মেটানো যেতো। করোনাকালে আদালত বন্ধ থাকার পর চরম বেকায়দায় পড়েছি। সামনে আর কতদিন বন্ধ থাকে আদালত তা নিয়ে চিন্তায় আছেন তিনি।
গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী জহীর উদ্দীন মাহমুদ বলেন, প্রথমত শিক্ষানবিশদের এই দুঃসময়ে বেশি বেশি করে দেখা সিনিয়দের উচিত। দ্বিতীয়ত শিক্ষানবিশদের জন্য সিনিয়ররা একটি ফান্ড করা যায়, যাতে এই দুঃসময়ে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া যায়। তৃতীয়ত বারও যতটুকু সম্ভব সিনিয়রকে দিচ্ছে, সেখানে থেকে ব্যক্তিগতভাবেও শিক্ষানবিশদের একটি পার্সেন্টেজ দিতে পারে। একই বারের অধীনে সবাই আছি একসাথে। তো তাঁদেরকে কিছু সহযোগিতা করলেও বারের ক্ষতি হবে না।
গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতিরি সাধারণ সম্পাদক বলেন, সিনিয়ররা মানিবক জায়গা থেকে শিক্ষানবিশদের কিছু সহযোগিতা করতে পারে। তারা যেহেতু সিনিয়রদের সংস্পর্শে এসে কাজ করছেন সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মানবিক জায়গা থেকে তাকে ব্যক্তিগতভাবে সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা উচিত। তবে সিনিয়রদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা যেন এ বিষয়টি দেখে।
অ্যাডভোকেট জহীর উদ্দীন মাহমুদ আরও বলেন, আমাদের জুনিয়র যারা আছেন আমরা আমাদের মতো করে ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু সম্ভত ততটুকু সহযোগিতা করছি। আর এটি নির্ভর করে একজন সিনিয়র আইনজীবী একজন জুনিয়রের ওপর কতটুকু মানবিক তার ওপর। মূলত মানবিক দৃষ্টিকোণ থাকলে শিক্ষানবিশদের জন্য চিন্তা করতে হয় না। এখানে মানবিকতার জায়গাটা নেই বলেই জুনিয়ররা এই দুঃসময়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষানিবশ যে সিনিয়রের অধীনে আছেন সেই সিনিয়র যদি আর্থিকভাবে সচল হয়ে থাকে, তবে জুনিয়রকে দেখা অবশ্যই তাঁর দায়িত্ব। আর সেটি হয়ে গেলে বারের ওপর চাপও হয়না আবার এটি বারের দায়িত্বও না।
এর আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলার আইনজীবীদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে তালিকাভুক্ত আইনজীবীরা আপাতত কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেলেও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কথা কেউ ভাবছে না।
স্বল্প আয়ের আইনজীবী বা কনিষ্ঠ আইনজীবীদের জন্য একটি তহবিল গঠন করার একটি প্রস্তাব ইতোমধ্যে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মততাজ উদ্দিন মেহেদী এই প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি গত ২৮ মার্চ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে একটি লিখিত প্রস্তাব দেন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, করোনার প্রাদুর্ভাবের এই দুঃসময়ে বা ভবিষ্যতে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কনিষ্ঠতম আইনজীবী বা স্বল্প আয়ের আইনজীবীদের জন্য একটি তহবিল গঠন করা উচিত। কারণ তাঁরা জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে আদালত বন্ধ থাকায় তাঁরা দুঃসময়ে দিন কাটাচ্ছেন। এ সময় তাঁদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এই তহবিল গঠনে দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীসহ সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য বিত্তশীলরা এগিয়ে আসতে পারেন।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ













