মহসীন কাজী »
কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকেই যে খাতটিতে সবচে’ বেশি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা শুরু হয় সেটি হচ্ছে গণমাধ্যম। এ মাধ্যমে বিশ্বময় অস্থিরতা দেখা দিলেও দ্রুত প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। মহামারি শুরুর একমাস না যেতেই প্রিণ্ট, ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন ও এফএম স্টেশনগুলোর মালিকরা যেন পথে নেমে গেছেন। ভাবটা এমন একমাসের মন্দাভাবে যেন তাদের কোষাগারে টান পড়েছে। ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করে আসা আর লোকসানি কোনটাতে তফাৎ খুঁজে পাওনা যাচ্ছে না। সবাই যেন একযোগে ফতুর। কোন মালিকের আচরণে কোনো ফাঁরাক নেই।
প্রতিষ্ঠানের আকার আকৃতি ভিন্ন হলেও কণ্ঠে তাদের একই সুর ‘মহামারিতে আয় রোজগার নেই’। এই এক সুরেই গণমাধ্যমে চলছে অস্থিরতা। চোখ-মুখে অন্ধকার দেখছেন সাংবাদিক কর্মচারিরা। পরিবার পরিজন নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন গণমাধ্যম কর্মীদের বিশাল অংশ। আর ভবিষ্যতে অন্ধকারের ছায়া দেখছেন অনেকেই।
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে লকডাউনের শুরুতেই আঁধার কালো মেঘ নামে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে। লকডাউনের অজুহাতে অনেক জাতীয় পত্রিকার প্রিণ্ট ভার্সন ছাপা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভাগীয় শহর এবং মফস্বলের স্থানীয় পত্রিকার বেশির ভাগেরই ছাপা বন্ধ শুরু থেকে। জাতীয়, স্থানীয় মিলিয়ে তিনশতাধিক পত্রিকার প্রকাশনা এখন বন্ধ। অনেক বহুল প্রচারিত পত্রিকা কমিয়ে দিয়েছে তাদের পৃষ্ঠা সংখ্যা। প্রিণ্ট বন্ধ রাখা অনেকেই চালু রেখেছে শুধু তাদের অনলাইন সংস্করণ।
ধরলাম, সংক্রমণের ফলে লকডাউনের কারণে কর্মীদের সুরক্ষা হোক কিংবা বিপণনসহ নানা অসুবিধায় পত্রিকাগুলো উল্লিখিত কর্ম করেছে। এটা হলেও হতে পারে সাময়িক। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যার আসল চিত্র বেরিয়ে এসেছে এপ্রিল, মে মাসের বেতন এবং ঈদুল ফিতরের বোনাসের সময়।
সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে এই করোনাকালে সাংবাদিকসহ সকল স্তরের গণমাধ্যমকর্মীদের খবর আমরা রাখি। এ সময় সবেচে’ উদ্বেগের সাথে যেটি লক্ষ্য করা গেছে, সেটি হল নির্লজ্জভাবে সাংবাদিক কর্মচারিদের ঠকানোর প্রবণতা। এই এক করোনার অজুহাতে অনেক গণমাধ্যম তাদের সাংবাদিক কর্মচারিদের বেতন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। হাতেগোনা ছাড়া কেউ বেতনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেনা। কেউ ঈদের সময় একমাসের বেতন দিলেও বোনাস দেয়নি। কেউ বোনাস দিলেও দিয়েছে বেসিকের অর্ধেক। ধারাবাহিকভাবে লাভে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও বোনাস নিয়ে তামাশা করেছে তাদের কর্মীদের সাথে। যা এ মাধ্যমের কেউ মেনে নিতে পারেনি। আবার অনেকের এমন কর্ম দেখে-শুনে বিস্মিত হয়েছেন বুদ্ধা মহলও।
যেমন ধরুন প্রথম আলো’র কথা। এ পত্রিকাটি তার সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপনসহ সার্বিক গুণে-মানে অনন্য, এটা স্বীকার করতেই হবে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রথম আলো শীর্ষে অবস্থান আছে- এটা তারা নিজেরাই প্রচার করে। পাঠক নন্দিত এই পত্রিকা দুই মাসের করোনার অজুহাতে সাংবাদিক কর্মচারিদের বোনাস অর্ধেকে নামিয়ে আনার খবরটি বিস্ময়ের মনে হবে অনেকের কাছে। তবে ঘটনা বাস্তব। প্রথম আলোও তার কর্মীদের বোনাস দিয়েছে অর্ধেক। ইদানিং আরেকটি অবাক করার মতো ঘটনাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়েছে। প্রথম আলো নাকি কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছে বিভাগীয় প্রধানদের। এ খবরে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশের সাংবাদিকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বিএফইউজে (বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন)। সংগঠনটি এই মহামারিতে কোনো গণমাধ্যম থেকে সাংবাদিক কর্মচারিদের ছাঁটাই প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছে।
টানা মুনাফা অর্জনে শীর্ষে থাকা সংবাদপত্র প্রথম আলো’র যখন অবস্থা তার বিপরীতে অন্যান্যগুলোতে কী চলছে তা সহজেই অনুমেয়। বলতে গেলে ফকিরাপুলের আন্ডারগ্রাউন্ড আর কাওরান বাজারের বহুতলার আচরণ একই। বিজ্ঞাপন খাদক আর ভালোর সাথে চলাদের এক জায়গায় এই এক সুর। তা হচ্ছে সাংবাদিক কর্মচারিদের বেলায়। ঠকানোর বেলায় একই লাইন। আর প্রচারের বেলায় ভিন্ন সুর। আমজনতা ভাবছেন, ভালোর সাথে চলাদের সবকিছুই ভালো। আসলে যে তারা বেলাইনের তা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছেন।
এই ধরুন, নবম ওয়েজ বোর্ডের কথা। কার মামলায় ওয়েজ ঝুলে ছিল আর এখন কেন ঝুলে আছে সবই আমাদের জানা। এর আগের ওয়েজ বোর্ডগুলোতে কি জুটেছিল তার সাক্ষীও আমরা। আজ করোনাবেলায় সেদিকে গেলাম না। থাকি এখনকার অবস্থা নিয়ে।
করোনা সংক্রমণের এই মহামারিতে শোনা যাচ্ছে, অনেক ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিণ্ট মিডিয়া ও অনলাইনসহ অন্যান্য মিডিয়া সাংবাদিক, কর্মচারিদের বেতন ভাতা বকেয়া রেখে কর্মীদের ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। কর্মী কমানোর পথে হাঁটছেন। এ অবস্থায় নানা শঙ্কায় চোখমুখে অন্ধকার দেখছেন সারাদেশের সাংবাদিকরা।
দুর্যোগের এই অভাবের কালে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়ে আবারো মানবিক মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বরাবরই তিনি সাংবাদিক বান্ধব প্রধানমন্ত্রী, তিনি নিজেকে গর্বের সাথে পরিচয় দেন সাংবাদিক পরিবারের সদস্য হিসেবে। এ যাবতকালে সাংবাদিকদের কল্যাণমূলক প্রতিটি কাজে এগিয়ে এসে তিনি তার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন। এর আগে সাংবাদিকদের কল্যাণে গঠন করেছেন সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট। শূন্য ট্রাস্টে মোটা অংকের তহবিলের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। এ ট্রাস্ট থেকে অসহায়, অসুস্থ সাংবাদিক এবং সাংবাদিক পরিবার আর্থিক অনুদান পাচ্ছেন। এই করোনা দুর্যোগেও সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের চেক বিতরণ শুরু হয়েছে। করোনায় প্রাণ হারানো সাংবাদিকদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে তিন লাখ টাকা। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে নিহত সাংবাদিকদের পরিবারের জন্য সরকারি অনুদান মিললেও অন্য কোন সাংবাদিকের পাশে সরকার দাঁড়াচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নজির সৃষ্টি করা আমাদের প্রধানমন্ত্রী উদার। শুক্রবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের মধ্যে উপহারের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দেশের সকল সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আওতায় আসবেন।
গণমাধ্যম কর্মীরা চাকরি করেন মিডিয়া মালিকের অধীনে। এই দুর্যোগে মিডিয়া মালিক যখন আমাদের ঠকানোর নানা ফন্দি করে তখন সরকার সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়ে উদারতা ও মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ সাংবাদিক, কর্মচারিদের মেধা আর ঘামে টিকে থাকে মালিকের ব্যবসা। তাদের দেখিয়ে সরকার থেকে নেন নানা সুবিধা। কর্মীদের বাস্তবে যেটা দেয় তার কয়েকগুণ বাড়তি দেখিয়ে আদায় করে বিজ্ঞাপনের রেটকার্ড। সুবিধা নেন কাগজ আমদানির ক্ষেত্রেও। সুতরাং সাংবাদিকদের সুরক্ষায় এ মুহূর্তে প্রয়োজন সরকারের হস্তক্ষেপ। দেশের সাংবাদিকদের বৃহৎ সংগঠন বিএফইউজে’র দাবি অনুযায়ী চাকরির সুরক্ষা এবং নিয়মিত বেতন-ভাতা আদায়ে সরকারই পারে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম কর্মীদের দুশ্চিন্তামুক্ত করতে।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)













