৩ নভেম্বর ২০২৫

ড্রেজারে বালি উত্তোলন : ভাঙন ঝুঁকিতে বাঁকখালীর দু’পাড়ের ফসলী জমি-সড়ক-বাড়িঘর

কক্সবাজার প্রতিনিধি »

২০১০ সালের বালু উত্তোলন নীতিমালায় যন্ত্রচালিত মেশিন দ্বারা ড্রেজিং পদ্ধতিতে নদীর তলদেশ থেকে বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ। এছাড়াও সেতু, কালভার্ট, ফসলী জমি ও রেললাইনসহ মূল্যবান স্থাপনার এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন বেআইনি। এতসব নিষেধাজ্ঞাকে পরোয়া না করে সড়ক ও দু’পাশের ফসলী জমির ১০-২০ গজের মধ্যে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর সদরের খরুলিয়া ও রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি অংশে স্যালো ইঞ্জিন চালিত ড্রেজার দিয়ে রাত-দিন বালি উত্তোলন করে বিক্রি করছে প্রভাবশালী ও পেশাদার বালি খেকোরা। এতে নদীর দু’পাড়ে ইতোমধ্যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নদীগর্ভে ফসলী জমি, সড়ক ও গ্রামীণ বাড়িঘর বিলীন হওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, বাঁকখালী নদীর দক্ষিণাংশে জনগুরুত্বপূর্ণ মিঠাছড়ি-রাজারকুল সড়ক আর উত্তরাংশে খরুলিয়ার কোনার পাড়া, ঘাটপাড়া। নদীর সাথে উভয়পারের দুরত্ব প্রায় ২০-৪০ গজের। এ অংশেই নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে তীরবর্তী ফসলি জমি ও বাড়িঘর বিলীন হবার আশঙ্কায় রয়েছে দু’পারের দুটি গ্রামের অগণিত মানুষ। এনিয়ে চাপা আতঙ্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাদের মতে, একাধিক বার বুঝিয়েও বালু খেকোদের রোধ করা যায়নি। উল্টো নানা হুমকি-ধমকি দিয়েছেন প্রভাবশালী বালুখেকোরা।

তাদের মতে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদীর গভীর থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রশাসনের অবহেলায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বালু দস্যুরা। বালি তোলার ফলে নদীর ভাঙ্গনরোধে বসানো কোটি টাকার আরসিসি ব্লকও সরে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঁকখালী নদীর উত্তর পাড়ের খরুলিয়া কোনার পাড়ার জাহাঙ্গীর নামের এক যুবকের নেতৃত্বে বেলাল, দুদু মিয়াসহ স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র নদীতে ২টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করছে। তাদের ড্রেজার বসানোর স্থানের দক্ষিণে মিঠাছড়ির পশ্চিম উমখালী এলাকার বাঁকখালী নদীর তীর ভাঙ্গন রোধে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আরসিসি ব্লক বসানো রয়েছে। বালি খেকোরা নদী থেকে বালি উত্তোলনের পাশাপাশি নদীর তীরের ফসলী জমিতে জমা পলি মাটিও প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন মাটি ও বালু ভর্তি অসংখ্য ট্রাক চলাচলের কারণে নদীর তীরের কাঁচা সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দূর্ভোগে পড়ছে জনচলাচল। সব মিলিয়ে এলাকার ফসলি জমি, নদীর পাড়ের ব্লক ও বিভিন্ন স্থাপনা হুমকির মুখে পড়েছে। বাড়ছে নদীর তীর ভাঙনও।

ভিডিও দেখতে নিচে ক্লিক করুন…

রামুর মিঠাছড়ির উমখালী গ্রামের আবদুল করিম, রহমত উল্লাহ (ছদ্মনাম) বলেন, গত বছরও কোনারপাড়ার ‘জাহাঙ্গীর সিন্ডিকেট’ ওয়েস্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হয়ে কয়েক কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করে। এরপর পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে নদী গর্ভে তলিয়ে যায় আমাদের পাঁচ একর ফসলি জমি। বালি তোলে কোটি টাকা পাওয়া যায় দেখে লোভের বশবতী হয়ে এবার নিজস্ব ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করেছে তারা। এভাবে বালি উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নদীর ভাঙ্গনে আরসিসি ব্লক, নদীর তীরবর্তী উমখালী, পশ্চিম উমখালী, মিঠাছড়ি, ঘাটপাড়া গ্রামের শত শত একর আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার আশংকা রয়েছে।

স্থানীয় চাষীরা জানান, শুকনো মৌসুমে নদীর চরে শত শত একর জমিতে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ হতো। বর্গা কিংবা লীজে চাষাবাদ জীবিকা নির্বাহ করতো শত শত চাষী পরিবার। কিন্তু তীরের জমির পলি তুলে নিয়ে খানাখন্দ করায় আগের মতো চাষাবাদ করা যায় না। আবার পলির উপর বালি জমিয়ে রাখায় অনেক জমি চাষের আওতামুক্ত থাকছে। এসব বিষয় বলতে গিয়ে বালি খেকোদের দ্বারা হত্যার হুমকির শিকার হতে হয়েছে। অভিযোগের পর রামু উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা কয়েকবার অভিযানে এলেও আগাম খবর পাওয়ায় তা বিফল হয়েছে। প্রশাসন আসার আগে মেশিন গুলো তুলে নিয়ে চলে গেলে আবার আগের জায়গায় বসানো হয়। ভুক্তভোগীদের মতে, এভাবে বালি উত্তোলন অব্যাহতথাকলে ভরা বর্ষায় বসত ভিটা ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলন হবে।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বালি উত্তোলনকারী জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, শুধু আমি নয় মিঠাছড়ির পেশাদার কিছু চক্রও বালি তুলছে। আমি বালি তুলে নিজেদের জমিতে রাখি এবং পরিবহনে আমাদের জমিতে তৈরী সড়কই ব্যবহার করছি। এলাকার সড়কপথ ক্ষতির প্রশ্নই আসে না। তবে, বালি তোলার প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, নদী থেকে ড্রেজারে বালি তোলা আইনসিদ্ধ নয়। তবে, তীরে জমে যাওয়া মাটি তুলে নিলে বন্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, এভাবে বালি তোলা সম্পূর্ণ অবৈধ। অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলে কিছুই পাওয়া যায়নি। মনে হলো পথিমধ্যে তাদের কোন স্পাই লাগানো আছে। এবার সেসব মাথায় রেখেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ

আরও পড়ুন