১ নভেম্বর ২০২৫

বোধের গোদ রোগ, মন্বন্তরে সোনা দরিয়া বয়ান

রাজীব কুমার দাশ »

সোনা বন্ধু আমার ইঁচড়ে পাকা ক্লাসমেট। সারাদিন ভাত শালিকের মতো ট্যাঁ-ট্যাঁ স্বভাব।ক্লাস ছাড়া থিতু হয়ে বসার কোথাও একটু সময় নেই।সোনার মতো গায়ের রং বলেই আদরে সবার সোনামিয়া, সোনাবন্ধু, সোনাপাখি, চড়ুই, বাবুই যন্ত্রনা সহ্য করে টেস্টোস্টেরন হরমোন পেয়ে রাতারাতি পাল্টে যান।ঈষৎ মিহি সোনালি পাট আঁশের মতো গোঁফদাড়ির উঁকিতে সোনাবন্ধুর বেশ অস্বস্তি! কিশোর বয়:সন্ধিকাল সব পুরুষের
জন্যে বেশ বিব্রতকর। গলার স্বর পরিবর্তন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চরম আগ্রহ, ঘুমের ঘোরে অশ্লীল স্বপ্ন, অশ্লীল আচরনে ঝোঁক, নারী খেলার সাথীরা এড়িয়ে চলা ইত্যাদি।

কিন্তু আমাদের সোনাবন্ধু বয়:সন্ধিকাল মানতে নারাজ। সে একধাপ এগিয়ে কিশোরী ভ্রুকুটি ধনুকের টংকারে, সরু আনাড়ি গোঁফ, পকেটে মৌসুমি ফুল, খুচরা টাকা, ভাংতি পয়সা, নতুন সুগন্ধি পাউডার রুমাল নিয়ে ছাত্রীদের কমন রুমের সামনে বেশ আনাগোনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে স্যারদের কিংবা সিনিয়র আপুদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।সবাই মনে করেছে তুলতুলে নাদুস-নুদুস ছেলে সোনার মতোই পবিত্র। কিন্তু সোনা যে ইঁচড়ে পাকা; ভাজা মাছ উল্টে খেয়ে ফেলে, তা কেউ না জানুক, না বুঝুক আমি, কিসলু, সাহেদ, ইউসুফ ভালো করেই জানি।

জানার কারণ, আমরা প্রাইমারি হতে একসাখে।এখন আমরা নিউ টেন।সোনা পরিবারের বেশ আদর,প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে। এ নিষ্ঠুর পৃথিবী সোনাবন্ধু মকমলের ফুলশয্যা। আনন্দ আর আনন্দ! সোনার আদিখ্যেতা’র কারণে স্যারদের কতো যে পিটুনি খেয়েছি,মনে নেই।একবার টিপু বিএসসি স্যারের বাসায় পড়তে গিয়ে আমাদের বেধড়ক পিটুনি হজম করতে হয়েছে। সামান্য অজুহাত দিয়ে স্যার আমাদের প্রায় সপ্তাহখানেক কুকুর-বেড়ালের মতো মেরেছে। কিন্তু সোনামিয়া অসুখের বাহানা দিয়ে আসেননি। যেদিন স্যারের বাসায় এসেছে, সাথে করে বাবাকে এনেছে। পেট খারাপ, জ্বর, ভয়রোগ নিয়ে সোনা পার করেছে অনেকবার।

আমরা সবাই টিপু (বিএসসি) স্যারের নির্দয় প্রহারের কোনো রহস্য বের করতে পারিনি। সোনা বলল- ‘তোরা সবাই কাল বিকালে জোড় পুকুরপাড় আসিস, মাইরের রহস্য বলবো।’ সবাই বসে আছি! সোনা কিন্তুু আসেনা, মিনিট দশেক পরে সোনা আঞ্চলিক গানের সুরে-স্বরে হাজির।রহস্য যা দেখেছি,তা রীতিমত বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! আমাদের সোনাপাখি টিপু বিএসসি স্যারের গোপনে রাখা আবুল হাসনাতের ‘যৌন বিজ্ঞান’ দুটি খণ্ডই নিয়ে এসেছে। ওদের কাছারি ঘরে অসুখের দোহাই দিয়ে চুপিচুপি পড়েছে। আমাদের ঘোরে-দৌঁড়ে একাকার! জীবনে প্রথম নারীকে বহুমাত্রিক যৌনতা, ঘরনা, তাড়না-ভাবনা নিয়ে বইয়ের পাতায় দেখার শিহরণ। সবারই চোখে, মুখে শিশির বিন্দু ঘাম। বুক ধড়পড়, কান গরমে ভোঁ-ভোঁ শব্দ। একি দেখলাম! এতো অল্প বয়সে সোনা চড়ুইপাখির কারণে সবাই ছুঁতমার্গ হলাম?

কারো মুখে কোনো কথা নেই।দেহ,মন এক অদৃশ্য ভাবনার দোলাচলে জবুথবু হয়ে বসে আছি।সোনামনি বেশ আমুদে, নারীদেহের কাম রাক্ষসের পরিতৃপ্তি তার চোখেমুখে।কামাতুর-কামাহত ভাবনা’য় পৃথিবীর সব অনূঢ়া যুবতী তার চাই।আবির রং মেখে সূর্য আস্তে আস্তে দিগন্ত রেখাপানে হারিয়ে যাচ্ছে।হতবাক প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে কৈতব মনে কৈবর্ত যুদ্ধ করছি, বারবার হেরে যাচ্ছি।নিজেকে বেশ অপরাধি মনে হচ্ছে।আলো আঁধারিতে জোনাকিপোকা মিট মিট করে জ্বলছে।

সোনা চোখ বন্ধ করে একলাফে বাইশ ক্যারেট। বস ভাব!দুবাই পরিবার। রাতে ভিসিআর দেখে স্কুলে তোফা, নাগিন, কুলি, ইনকিলাব, এক ফুল দো মালির ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। তার দেয়া, স্যার, ক্লাসমেট ছাত্রছাত্রী সবার আলাদা নাম। কিমি, দিব্যা, শ্রীদেবি, হেমা, মাধুরি, রেখা গোবিন্দ, শাহরুখ অগুনতি। বেত্রাহত হলে স্যারদের নাম হতো, অমরেশ পুরি, অনুপম খের, ড্যানি সিডাক। আমরা ২০/২১ ক্যারেট ছুঁই ছুঁই!

সোনা একলাফে ২৩ ক্যারেট, চেতনায় মুঠোমুঠো প্রেম বিলিয়ে আনন্দে গেয়ে চলেন–আঞ্চলিক, রবীন্দ্র, নজরুল, বিচ্ছেদ, লালন।কিন্তু মনে শান্তি নেই। প্রতিদিনই একগাদা অভিযোগ সোনার বাবা ‘মন্বন্তর’ যন্ত্রনা নিয়ে সহ্য করেন। সোনার চিন্তা এবার ঘর বাঁধবে।খুচরো প্রেম দিয়ে-নিয়ে কোনো লাভ নেই! সবাই পাতি শেয়ালের মতো তাকিয়ে থাকে, হাসি, কাশি, চুপিচুপি চোখ হিংসা কারো সারেনা। বাবার একমাত্র বংশ প্রদীপ। অঢেল সম্পদ, যে ভাবা, সে কাজ! ক্লাসমেট জ্যোৎস্না কে বেশ পছন্দ,বয়স সমানে সমান। সিনিয়র হলে ও আপত্তি নেই। কিন্তুু নিজেই চুপিসারে বিয়ে করতে হবে, কারণ বাবার আশার দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে জজ ব্যারিস্টার হবার ধৈর্য্য, সময়, ইচ্ছে, কোনোটাই সোনা বন্ধুর নেই।

ইয়ে (মানে) ২য় খণ্ড পড়া শেষ। অশ্লীল মানব মনকে শ্লীল করতে সোনা বদ্ধপরিকর।আমরা সবাই সায়েন্স নিয়ে পড়ছি।জীববিজ্ঞানে সোনাবন্ধু বেশ মার্ক পেয়ে থাকেন।সোনা বলেন, ‘দ্যাখো জীবকোষ, টিস্যু, প্রজনন, জীবের বংশগতি ও বিবর্তন, বায়োলজিক্যাল ক্লক (Biological clock) অহর্নিশ কাজ করে চলেছে। মনের দৈন্যদশা নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারছিনা। একদিন মানব মনকে দরিয়ার মতো বড়ো করে দেবো।আমার জীবনকাহিনী গল্পে ছবির নাম হবে-সোনাদরিয়া’।

এদিকে টিপু স্যারের বিয়ে ভেঙ্গে যায় যায় অবস্থা। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে।স্যার বিয়ের প্রস্তুতি নিতে বেশ সময় পার করে ফেলেছেন। উর্বর বিজ্ঞানসম্মত জীবনে স্যারের আবেগ, বেগ, বেশ কম। এ পর্যন্ত প্রেম তীরের বিষ স্যার’কে কাবু করতে পারেনি।এবার পরিবারের তাড়না-ভাবনা নিয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। এসএসসি’র প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষায় সোনাবন্ধুর জীববিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নাম্বার! টিপু বিএসসি বলে কথা। সোনাবন্ধু এবার যাইবা কই? সোনাবন্ধু ভাত শালিক বেশ কিছু উত্তর অতিরিক্ত হিশেবে পাঠ্যের বাইরে দিয়েছে, যা-না দিলে সোনাবন্ধু বিএসসি স্যারের নজর এড়াতে পারতো। বিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আদর্শ স্বামী হতে- স্যার, মামাতো জুঁই ভাবি, বন্ধুর ধারে নেয়া চটি ঘরনার যে কটা বই পেয়েছে,তার মাঝে’ফুলশয্যার রাত,বিয়ের আগে ও পরে,স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, সোনামনিদের সুন্দর নাম থাকলে ও দূর্লভ ঘরনার ‘যৌনবিজ্ঞান’ বইটা লাপাত্তা। স্যার চিন্তা করেছিলেন- এ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ড পড়েই ‘বাসর’ পরবর্তী সময় পার করবেন।বই মিস করায় বিলম্বের কারন।কিন্তু স্যার এ চরম সত্যিটা কি করে বলবেন।

অবশেষে এলো, সে কাংখিত বিদায়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।হাতে সবার খাবার প্যাকেট।ঠান্ডা সিঙ্গারা ফেটে সাদা আলু,নরম জিলাপি,হাতে লেগে বসে আছি।বিদায়ের অদৃশ্য লহমা বারবার ডাকছে,সবাই একনজরে সব দেখছে,কমনরুম,ক্লাস রুম।সোনা দরিয়া সবাইকে তাক লাগিয়ে সেরা ছাত্রের পুরস্কার জিতে নিয়েছে।কেউ বিশ্বাসই করতে চাননা।জুঁই,চামেলি,মালতি,কেতকি প্রমাদ গুনলেন।দরিয়া উঠে দাড়ালেন, কিছু বলতে চান।প্রধান শিক্ষক অনুমতি দিলেন।”স্যার আমি কোনোদিনই ভালো ছাত্র হতে চাইনি,চেয়েছি ভালো মানুষ হতে!শিক্ষণ-বীক্ষণ নিয়ে যতোদিন লুকোচুরি খেলবো,বর্ণচোরা হয়ে বিবর্ণ হবো,স্ববিরোধী আচরণ করবো, ততোদিন আপনাদের চোখের সামনে চরম অবহেলা নিয়ে জন্ম নেবে নতুন-নতুন সোনাবন্ধু, সোনামিয়া, সোনাপাখি, সোনা বাবুই। তবে, আমি কথা দিচ্ছি-একদিন সোনাদরিয়া কাহিনীকার হয়ে সবার সামনে প্রকটিত হবো।পৃথিবীতে আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসেনা।যোগ্যতার মাপকাঠি দিয়ে মেপেমেপে ভালোবাসে।সবারই বোধের গোদ রোগ”।যা কোনোদিনই সেরে ওঠার নয়।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ