৩১ অক্টোবর ২০২৫

কোটি টাকা ব্যয়ে ইয়াবা গডফাদার শাহাজান চেয়ারম্যানের রাজকীয় সংবর্ধনায় চাঞ্চল্য

কক্সবাজার প্রতিনিধি »

মাদক ও অস্ত্র মামলায় দীর্ঘ দেড় বছর কারাভোগের পর জামিন পেয়ে আলোড়নে এলাকায় ফিরেছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া।

বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বিকেলে ঢাকঢোল পিটিয়ে ফিল্মী স্টাইলে প্রায় পাঁশ শতাধিক গাড়ি বহর নিয়ে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পৌঁছান শাহজাহান। এসময় তার গলা ফুলের মালায় ভরিয়ে দেয়া হয়। রাস্তার দুই পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় হাজারো মানুষ। তাদের উদ্দ্যেশে হাতও নাড়েন মাদক ও অস্ত্র মামলায় দীর্ঘ দেড় বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হওয়া বিতর্কিত তরুণ এ চেয়ারম্যান।

দু’শতাধিক নোহা মাইক্রোবাস, তিন শতাধিক মোটরসাইকেল ও কয়েকটি খোলা জীপে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনায় মেরিন ড্রাইভ দিয়ে এলাকায় আনা হয়। অথচ তিনি একাধিক মাদক মামলার আসামি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ৯ নাম্বারে থাকা আলোচিত ইয়াবা গডফাদার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় দাবি করেছেন, গায়ে লাগা কালি ঢাকতে তার (শাহাজানের) নির্দেশে রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। গত দশদিনের প্রচেষ্টায়  প্রায় দুই কোটি টাকা খচর করে সংবর্ধনা সফল করেছে তার সহযোগী ইয়াবা সিন্ডিকেট।

সূত্রের দাবি, সংবর্ধনার জন্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে দু’শতাধিক নোহাগাড়ি আনা হয়েছিল। প্রত্যেকটি নোহার ভাড়া নির্ধারণ ছিল ১৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে নোহার ব্যয় ৪৫ লাখ টাকা। টেকনাফ-থেকে কক্সবাজার আসা যাওয়া করা প্রত্যেক বাইককে দেয়া হয়েছে তিন হাজার করে। এতে খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। অন্যান্য যানবাহন বাবদ খরচ হয়েছে আরও ১৫ লাখ টাকা।

সূত্রটি আরো জানায়, সংবর্ধনার জন্য ভাড়া করা এক হাজার লোককে সেদিনের বেতন বাবদ  জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। এর বাইরেও ফুল চা-নাস্তা ও এক বেলা খাবারের বিলে খরচ হয় অন্তত ১০ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে ইয়াবা গডফাদার খ্যাত শাহজাহান রাজকীয় সংবর্ধনা নিয়েছে। তিনি যেমন দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্বাচিত সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান তেমনি সর্বকনিষ্ঠ মাদক গডফাদারও। 

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সদ্য কারামুক্ত শাজাহান মিয়া বলেন, আড়াই শতাধিক নোহা গাড়ি, তিন শতাধিক বাইকসহকারে হাজারো মানুষ আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। তবে সংবর্ধনায় ব্যয় করা টাকার একটি পয়সাও আমি খরচ করিনি। যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা-ই এসব টাকা খরচ করেছেন। তাদের ভালোবাসায় আমি সিক্ত।

তিনি বলেন, আমি দক্ষিণ চট্টগ্রামের নির্বাচিত সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বহিষ্কার হয়েছি। জামিন পেয়ে আগে হাইকোর্টে গিয়ে রিট করেছি। তারপরই এলাকায় ফিরলাম। আশা করছি খুব শীগগিরই আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে। আমার জন্য অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে এখনো হচ্ছে। আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।

এদিকে, ইয়াবার গডফাদার খ্যাত শাহাজান মিয়ার রাজকীয় সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সচেতন নাগরিকরা।

আবদুল কাদের নামে একজন লিখেছেন, এভাবে চলতে থাকলে সমাজে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দাপটে ভাল মানুষ আর টিকে থাকতে পারবে না। সীমান্ত এলাকা টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজারে আবারো প্রশাসনে ইয়াবার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি চালু করা হোক।

আদনান সামি লিখেছেন, একজন ইয়াবা কারবারিকে গাড়িবহরে শোডাউন দিয়ে, গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে? ইনি একজন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি, উনার বাবাও একই অভিযোগে এখনো পলাতক। ধিক্কার জানাই এসব মানুষদের, ধিক্কার জানাই দেশের দুর্বল আইনকে।

আমিনুল ইসলাম নামে আরেকজন লিখেছেন, যার পরিবারের সকলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী, টেকনাফ সীমান্তের আলোচিত ইয়াবা সম্রাট জাফর আলমের ছেলে টেকনাফ উপজেলা শ্রমিকলীগের সাবেক সভাপতি শাহাজান মিয়াকে এইভাবে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নেয়া দুঃখজনক।

স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে রাজকীয় সংবর্ধনা নিয়ে বীরের বেশে এলাকায় ফিরেছেন গড়ফাদার শাহাজান মিয়া। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইয়াবা কারবারিরা আরও বেশি বেপরোয়া হতে সাহস পাবে।

বিষয়টি সম্পর্কে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলনা আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনেছি। শাহজাহান মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখনো তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি বলে জানান তিনি।

একজন শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার এভাবে সংবর্ধনায় এলাকায় ফেরায় ইয়াবা কারবারিরা আরও বেপরোয়া হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে, কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি শুনেছি কিন্তু ওইদিন আমি জরুরী বৈঠকে চট্টগ্রামে ছিলাম। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাবার সময় গত ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারী বেনাপোল সীমান্তে থেকে শাহাজাহান মিয়াকে গ্রেফতার করে জেলা পুলিশকে হস্তান্তর করে বেনাপোল পুলিশ। পরের দিন শাহাজানের দেয়া তথ্যে ভিক্তিতে অভিযান চালিয়ে তার বাড়ি থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা, ৪টি অস্ত্র ও ২৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর কারাগারে থাকাকালীন মাদক মামলায় আদালতে চার্জ গঠন হলে চেয়ারম্যান পদ থেকে শাহজাহান মিয়াকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। দীর্ঘ ১৮ মাস কারান্তরিণ থাকার পর জামিনে বেরিয়ে রাজকীয় সংবর্ধনা নিয়ে এলাকায় এসেছেন সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির আস্থাভাজন জাফর আহমদের ছেলে শাহজাহান মিয়া। তিনিও বদির কলকাঠিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

বাংলাধারা/এফএস/এইচএফ

আরও পড়ুন