২৪ অক্টোবর ২০২৫

কিশোর সমাজের অধিকার, সেবাকেন্দ্র দরকার

আরশি ইরতিজা  »

শরীয়তপুরের মাদ্রাসায় পড়ুয়া ১৩ বছরের কিশোরী হারিসা আক্তার। হাসিখুশি এবং পড়াশোনায় আগ্রহী  মেয়েটি চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হলো। গৃহকর্মী হিসেবে একটি মধ্যবিত্ত ঘরে তাকে চাকরি দেওয়ার পরে পড়ালেখার অগ্রগতি আর হলো না। কিছুদিন আগে মাসিক অসুস্থতার সময় গুরুতরভাবে সে অসুস্থ হয়ে গেলো এবং গৃহকর্ত্রী সাধারণ কিছু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে তাকে কাজে ব্যস্ত রাখলেন। বিশ্রামের প্রয়োজনটুকু বোধ করলেন না যেখানে, সেখানে হারিসা ভয়ে  কিছু বলার সাহস করতে পারলো না।

​​এরূপ দূর্গতির শিকার হওয়া কিশোর-কিশোরীদের জন্য নতুন কোনো উপাখ্যান নয় বাংলাদেশে। দেশের মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ জনশক্তি তাদের মৌলিক অধিকার থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত তা দুঃখজনক ভাবে আমাদের দৃষ্টিগোচরের বাইরে। বিশেষত, দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করেন কিংবা উন্নত শহরে বাস করেও পর্যাপ্ত সহযোগিতার সংস্পর্শে থাকতে পারেন না, তাঁদের মধ্যে মূলত অবজ্ঞাসূচক আচরণ অবলোকন করা যায়। বাল্যবিবাহের চর্চা এবং যৌনস্বাস্থ্যশিক্ষা স্বল্পতার এই দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সংকট কীভাবে অব্যাহত থাকে তা সহজেই উপলব্ধ হয় আমাদের  সমাজব্যবস্থার উপর।

​বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে ৬০৩ এর অধিক কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র বাংলাদেশে উপস্থিত থাকলেও অধিকাংশ সেবাকেন্দ্র জর্জরিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘসময় ধরে। সরকারি সেবাকেন্দ্রসমূহ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অফলাইন সেবা শুশ্রূষা প্রদান করেন, যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সীমিত এবং কৈশোরবান্ধব আচরণবিমুখ। একজন কিশোর/কিশোরী দিনে তার অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম কিংবা কর্মস্থলের ছুটি শেষে যেন সেবাকেন্দ্রে আসার সুযোগ পায় এরকম পরিবেশ তৈরি করতে সকল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা আবশ্যক। অতএব, অফলাইন স্বাস্থ্যসেবা সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত বরাদ্দ থাকা অতীব জরুরি। পাশাপাশি, রাতে অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা এবং ফোনকল সার্ভিস চালু রাখার মাধ্যমে অনেক কিশোর-কিশোরী উপকৃত হবেন। এমন অসংখ্য ছেলেমেয়ে আছেন, যারা সশরীরে উপস্থিত না থেকে সেবাকেন্দ্র থেকে সাহায্যের আশা রাখেন, তাঁদের সুস্থতাকে গুরুত্ব রেখে অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার আহ্বান জানাই। এছাড়া, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে অফলাইন সেবা সীমিত আকারে রেখে, অনলাইন সেবা ২৪ ঘণ্টাই কার্যকর রাখার বিনীত অনুরোধ জানাই কর্তৃপক্ষের কাছে।

​কিন্তু, আমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র সেবাকেন্দ্রে উপস্থিত থাকার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ? কী হবে সেই সকল কিশোর-কিশোরীদের যাঁরা হারিসার মত বঞ্চিত অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন? যাঁরা আদৌ জানেন না সেবাকেন্দ্রের সহজলভ্যতা প্রসঙ্গে? এইক্ষেত্রে, সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের মাসিক অভিযান চালু করা প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করি। প্রথমত, কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের একটি অভিযান রুটিনের আওতাভুক্ত করা উচিত, যেখানে একজন কর্মী কোন কোন এলাকার তথ্য সংগ্রহ করবেন তা লিপিবদ্ধ করা হবে। এর ফলে, কোনো ঘরে কিশোর-কিশোরীরা অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার হলেও তা দূরীভূত করতে কর্মীরা পদক্ষেপ নিতে পারবেন। তাঁরা সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ কিংবা উপদেশ দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন গৃহকর্তাদের। তাছাড়া, কিশোরীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ত্বরান্বিত করা যাবে, স্বাস্থ্যসেবার উপকরণ কিনতে অভিভাবকেরা উদ্বুদ্ধ হবেন এবং কিশোরদের মাঝে উপযুক্ত শিক্ষা বিতরণের পরে তাদের মধ্যকার অপরাধপ্রবণতার বিনাশ সম্ভব হবে। নিম্নবিত্ত এলাকাগুলোতে মাসিক অভিযান চালু করার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ হ্রাসকরণ সম্ভব হবে। অনৈতিক এবং অনুচিত বাল্যবিবাহ শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধে সেবাকেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক সাহায্য করতে পারবেন আমাদের সমাজকে। অতএব, শুধুমাত্র “দায়িত্ব” সরলীকরণের মাধ্যমে আমরা সমাজে সচেতনতা আনতে পারি।

​পাশাপাশি, সরকারি কিংবা বেসরকারি সেবাকেন্দ্রসমূহ সাপ্তাহিক কর্মসূচির আয়োজন করতে পারেন স্কুল-কলেজে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা বিতরণের জন্য স্কুল-কলেজ অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। বর্তমানে যদিও বেশকিছু স্কুল শিক্ষার্থীদের মাঝে সংকোচবোধ এবং ভ্রান্তি ভাঙাতে সুগঠিত শিক্ষাপ্রদান করছেন, অধিকাংশ নিম্নবিত্ত এবং তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছল স্কুলে শিক্ষকেরা এসকল বিষয় এড়িয়ে যান। শিক্ষার আলো কখনো আমাদের উগ্র করে তোলেনা। বরং আন্তরিক আলাপ এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দূরীভূত করবে আমাদের ভীতিসমূহ। তাই আমরা আশা রাখি, সরকারিভাবে এইসকল কর্মসূচি আওতাভুক্ত করা হবে। কিশোর স্কুলে পুরুষকর্মী এবং কিশোরী স্কুলে নারীকর্মী পৌঁছানোর আগে তাঁদের অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রত্যয়িত হতে হবে। অবশ্যই এই কর্মসূচি সাপ্তাহিক ভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন, যাতে করে সময় নিয়ে Ice Breaking Session এর মাধ্যমে কৈশোরবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য বই বিতরণের মাধ্যমে পাঠ্যসূচির বাইরেও সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারি আমরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তকে অনেক বিষয়ের উপর স্বচ্ছ ধারণা ফেলা হয় না, একারণে সেশনে বই সরবরাহ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। কিশোর-কিশোরীদের ব্যায়ামচর্চা ও খেলাধুলায় আগ্রহী করে তোলাকেও মুখ্য পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করা জরুরি। গৎবাঁধা শিক্ষার জালে আমরা ভুলতে বসেছি – “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”। এসব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষকদেরও জড়তা কেটে যাবে, তখন তাঁরা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান সরবরাহ করতে কোনো কার্পণ্য বোধ করবেন না। এইক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, “Be Expressive, but not Aggressive”.

​কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার নানা উপকরণের তুমুল ঘাটতি দেখা যায়। সাধারণ ওষুধ, স্যানিটারি প্যাড, যৌনরোগ প্রতিরোধকারী ওষুধপত্র – ইত্যাদি সর্বদা মেয়াদসহ সংরক্ষণ করা তাঁদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এমন অনেক সেবাকেন্দ্রে দেখা যায়, ধুলায় ধূসরিত হয়ে আছে তাঁদের অফিসগুলো। দেখে বোঝার জো নেই আদৌ এটি সেবাকেন্দ্র কী না। স্বাস্থ্য সুরক্ষা চার্ট, রজঃস্রাবের বিধিনিষেধ সম্বলিত বুকলেট এবং পোস্টার, কিশোর স্বাস্থ্য পরিবর্তনে করণীয় পোস্টার, পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যতালিকা অথবা, কৈশোরকালীন মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয় – যাবতীয় সকল নির্দেশাবলি দেয়ালে এবং প্রসপেক্টাস আকারে সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো কিশোর-কিশোরী অফিসে এসব পড়ে অনেক নিয়ম জানতে পারবেন। প্রতিটি পদক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে হবে কোন জিনিসটি ভালো বা খারাপ। তাঁরা যদি বাল্যবিবাহের প্রতি অনুৎসাহিত করতে পারেন সকল কিশোর-কিশোরীদের, তাহলে কিশোরসমাজ জেগে উঠতে পারবেন প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে। শুধুমাত্র এসব নয়, আচরণগত নির্দেশিকা সরবরাহ করাও প্রয়োজন। কোন ধরনের স্পর্শ বা আচরণ ক্ষতিকর, এসব থেকে নিজেকে রক্ষার্থে কিশোর/কিশোরী কী করতে পারেন এসবের উপায় ব্যাখ্যাসহ পোস্টারে থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর-কিশোরীদের মাদক থেকে দূরে রাখতে প্রভাবিত করতে হবে সেবাকেন্দ্রের কার্যক্রম দিয়ে। একজন মাদকসেবী এবং একজন সুস্থ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যতের পার্থক্য তুলে আনতে হবে সুচারুভাবে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, যদি কোনো কিশোর/কিশোরী গুরুতর সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, সেটার সমাধান তো সেবাকেন্দ্র অবশ্যই প্রদান করবেন। পরবর্তীতে, উল্লিখিত ব্যক্তির খোঁজখবর নেওয়া আমাদের মানবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সহানুভূতিশীল মনোভাব  কিশোর/কিশোরীর জীবনকে অনেক ইতিবাচক করে তুলতে পারে। কখনো তাদের প্রতি কটু উক্তি পেশ করে নয়, বরং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পেশ করা আমাদের দায়িত্ব। অতএব, সেবাকেন্দ্র হতে হবে সবসময় আপডেটেড।

কৈশোরকালীন ঋতুতে, কিশোরীদের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো তারা মাসিক রজঃস্রাবের মধ্য দিয়ে যায়। এইসময় তাঁদের যেমন নিজের প্রতি অতিরিক্ত সচেতন হওয়া দরকার, তেমনি ব্যবহার করা দরকার নিরাপদ স্যানিটারি প্যাড। দুর্গম কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক কিশোরী অধিক দামের প্যাড কেনার সামর্থ্য রাখেন না। ফলে ব্যবহার করতে হয় বাতিল কাপড়, যা অস্বাস্থ্যকর এবং বহন করে হাজারো জীবাণু। তাই দুর্গম এলাকার কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্রে স্বল্পমূল্যে সেরা স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করে রাখা যায়। কিশোরীরা নিশ্চিত থাকতে পারবেন এবং সেবাকেন্দ্রসমূহও তাদের আস্থাভাজন হয়ে থাকবে।

​​সেবাকেন্দ্রের সাথে চিকিৎসকদের যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয় করা জরুরি। সংকটাপন্ন সময়ে চিকিৎসক সরবরাহ এবং সেবাকেন্দ্র থেকে যানবাহন পাঠানো যেতে পারে। অপরদিকে চিকিৎসক যদি সেবাকেন্দ্রের রেফারেন্স জেনে নিতে পারেন, রোগীকে তিনি যথেষ্ট প্রাধান্য দিতে উৎসাহ পাবেন।

সর্বোপরি, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতার আকাঙ্ক্ষায় চলুন সকলে একত্র হই, দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এবং কণ্ঠ মিলাই এই শ্লোগানের সাথে, “সপ্তাহ জুড়ে সারাবেলা, কৈশোরবান্ধব সেবা থাকুক খোলা”।

লেখক: আরশি ইরতিজা, শিক্ষার্থী মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা (৩য় বর্ষ), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন