১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ড ‘পরিকল্পিত’!

সায়ীদ আলমগীর  »

উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বার বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ের বন রক্ষায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে দেয়া গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত না হওয়ায় গ্যাস থেকেই প্রায় অগ্নিকন্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানানো হতো। কিন্তু গত সোমবারের (২২ মার্চ) ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর এটিসহ ইতোপূর্বের সকল অগ্নিকান্ডকে পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ রোহিঙ্গারা। বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও ওপারের ষড়যন্ত্রে পরিকল্পিতভাবে এসব অগ্নিকান্ড ঘটনো হচ্ছে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গারা।

অসমর্থিত সেই রোহিঙ্গা সূত্র মতে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিগত নিপীড়নে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ রক্ষায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। ২০১৭ সালের এ রোহিঙ্গা আগমনের পূর্বে নব্বই দশকের শুরু থেকে নানা কারণে আরো প্রায় ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। নতুন পুরাতন মিলে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে ৩৪টি ক্যাম্প করে একত্রে বিশ্বের সর্ববৃহত আশ্রয় কেন্দ্র্র গড়া হয়। রোহিঙ্গাদের উপর ঘটা চরম অমানবিক এ ঘটনার জন্য সারাবিশ্ব মিয়ানমারকে ধিক্কার দেয়ার পাশাপাশি নানা ভাবে সমালোচনা শুরু করে। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা চালিয়ে আসছে মিয়ানমার জান্তারা।

সূত্রের দাবি, তারা (মিয়ানমার সামরিক জান্তা) কৌশলে ক্যাম্পে থাকা লোভী বিপদগামী কিছু লোকজনকে হাত করে ক্যাম্পে মারামারি, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত করান। রোহিঙ্গাদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধকর্ম নিয়ে মিয়ানমারের অর্থায়নে কিছু গণমাধ্যমকর্মী দ্রুত প্রতিবেদন তৈরী করে প্রচার করে। এসব প্রতিবেদন আবার সংগ্রহ করে মজুদ করছে মিয়ানমারের জান্তারা।

রোহিঙ্গা নির্যাতন ও তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলায় রোহিঙ্গাদের অপরাধী ও উগ্রবাদি হিসেবে প্রমাণের লক্ষ্যে মিয়ানমার এসব অপকর্ম করাচ্ছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। আর নির্বোধ রোহিঙ্গারা অর্থের লোভে মোহে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরা ডাকছে। মিয়ানমারের সেই ইন্ধন ছাড়াও ক্যাম্প কেন্দ্রিক চলমান বিশাল বাজার ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেও স্বার্থান্ধ রোহিঙ্গারা স্বজাতির সর্বনাশ করছে বলে দাবি সচেতন রোহিঙ্গাদের। এসব বিষয় নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের।

স্থানীয় গ্রামবাসীরও ধারণা, সোমবারের অগ্নিকান্ডাটি ‘পরিকল্পিত’। এলাকার বাজারে আসা-যাওয়া করা সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ‘আত্মঘাতী’। তবে এসব বিষয় নিয়ে রোহিঙ্গারা বেশী মুখ খুলতে রাজি নয়। কারণ, যারা এ ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তারা ক্যাম্পটিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। তাদের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলতে পারে না। এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের কাছে এক প্রকার জিন্মী সাধারণ রোহিঙ্গারা।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, বিপথগামী কিছু রোহিঙ্গা কেরোসিন দিয়ে নিজেদের ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে শুনেছি। শুনেছি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা দুই গ্রুপে বিভক্ত। তাদের এক গ্রুপ বিপথগামী এবং অপর গ্রুপে সাধারণ নিরীহ। অস্ত্রধারি বিপথগামীরা মিয়ানমার ফিরতে নারাজ। তারা বার বার এধরণের ঘটনা ঘটিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নস্যাৎ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায়। এসব রোহিঙ্গাদের সনাক্ত করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, বিপথগামী সশস্ত্র রোহিঙ্গারা এমন কোন খারাপ কাজ নেই যা তারা করতে পারে না। তারা দল বেঁধে ক্যাম্পে ক্যাম্পে অরাজকতা কায়েমের চেষ্টা করে। এসব রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, মুক্তিপণ আদায় ও ইয়াবা কারবার থেকে শুরু করে যাবতীয় অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকারও অভিযোগ সাধারণ রোহিঙ্গাদের। ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে এ পর্যন্ত ৬০ জনেরও অধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরটি আমার ইউনিয়নে। তাই ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। সোমবারের অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকে আমার কাছে যেসব খবরা-খবর এসেছে তাতে মনে হচ্ছে ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ । সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, একই সাথেই কয়েকটি স্থানে আগুন ধরার কারনেই দ্রুত আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই আগুন সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

পুড়ে যাওয়া ঘরের ধ্বংসস্তুপে ফেরা রোহিঙ্গাদের অনেকেও চেয়ারম্যান গফুর চৌধুরীর মতো তথ্যই সাংবাদিকদেও দিয়েছেন। তাদের মতে, ক্যাম্পের একাধিক স্থানে একই সময়ে আকস্মিক আগুন লেগে যায়। সাধারণ অগ্নিকান্ড একসাথে একাধিক বাড়িতে ঘটে না। কোন একটি বাড়ী থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে এত ব্যাপক ক্ষতি হত না। অগ্নিকান্ডের সময় ধোঁয়ায় বিষ্ফোরকের গন্ধ পাওয়া গেছে। দাহ্য পদার্থের উপস্থিতিতে আগুনের ফুলকি যেভাবে বহুদূও ছিটকে যায় ঠিক সেভাবে ক্যাম্পের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে যায় আগুন, এমনটি বলেছেন ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা।

তবে, গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরনেও এমনটি ঘটতে পারে বলে মনে করেন কিছু রোহিঙ্গা। কিন্তু যে গন্ধ এ সময় পাওয়া গেছে তা গ্যাস সিলিন্ডারের নয়-বরং বিষ্ফোরকের গন্ধ বলেই রোহিঙ্গাদের ধারণা। সশস্ত্র রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নানা কেমিক্যাল নিয়েও নানা ধরণের কাজ করে থাকে বলে মন্তব্য তাদের।

মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন কালে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. অনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন এটি নাশকতা কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীনকেও তার ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি এ নিয়ে কোন মন্তব্য না করে বলেন, গঠিত তদন্ত কমিটি এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে বলে জানান।

বুধবার (২৪ মার্চ) ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেছি। এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এ আগুনে অনেক স্থানীয় পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদেরকেও সহযোগিতার আওতায় আনা হবে। যাতে তারাও দ্রæত ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে। আগুন লাগার পেছনে যদি রোহিঙ্গারাও জড়িত থাকে তাহলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ