২৪ অক্টোবর ২০২৫

পর্যটকে মাতোয়ারা পাহাড়ী ঝর্ণা

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

পাহাড়, নদী আর সমুদ্র ভালো লাগে না এমন মানুষ পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের শেস নেই। তবে উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্নের অন্ত নেই। চট্টগ্রাম মানেই পাহাড় বেষ্টিত একটি শহর। ড্রোন ক্যামোরা দিয়েও যদি দেখা হয় তাহলে মনে হবে যেন হাজারো পাহাড় বেষ্টিত একটি গর্তের মতো স্থানে চট্টগ্রাম শহরকে ক্যামেরা বন্দি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের অনেক পাহাড় থেকে ঝলধারা নেমে আসে বিশেষ করে বর্ষাকালে। এমন চিত্রটি প্রতিনিয়ত চোখে পড়বে চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকাগুলোতে।

সবচেয়ে বেশী পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই মীরসরাইয়ে খৈইয়াছরা নামক এলাকায় বয়ে চলেছে দূর পাহাড় থেকে পানির কলতানে মুখরিত ছরা। এমন পরিচিতি মিলছে দেশীয় পর্যটকদের মাঝে। তবে তা আস্তে আস্তে সরকারী ও বেসকারী পর্যটন সুবিধা পাওয়া গেলে বিদেশীদের আকৃষ্ট করবে এমন ধারণা আগতদের। ঝর্ণার উদ্দেশ্যে কেউবা চলছে ছরার জলরাশি ধরে, আবার কেউবা পানি না মাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে কোলে মাটির পথ ধরে হেঁটে চলেছে। প্রকৃতি যেন তার সব সৌন্দর্য বিলিযে দিয়েছে সবুজ অরণ্যের পাহাড়ী ঝর্ণার পদতলে। পাহাড়ের কোলে কোলে গেলে ছোট বড় দোকান মিলবে আর ছরার পানিতে পা ভিজিয়ে চললে দেখা মিলবে নুড়ি পাহাড়ের সঙ্গে বহমান ঝর্ণার পানির মিতালী।

আবার পর্যটকদের সতর্ক করতে সরকারের বন অধিদফতরের পক্ষ থেকে আমেরিকা ভিত্তিক এনজিও সংস্থা এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনাল এর অর্থায়নে একটি র‌্যাপলিং ও জুমারিং সংক্রান্ত নীতিমালার সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়েছে। এক্ষেত্রে র‌্যাপলিং ও জুমারিং সঠিক নিয়মে করার জন্য আগতদের অনুরোধ করা হয়েছে। তবে যেকোনো ধরণের অবহেলায় বড় ধরণের সমস্যা বা দুর্ঘটনা সৃষ্টি হতে পারে। র‌্যাপলিং ও জুমারিং করার সময় ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ভাল ইন্সট্রাক্টরের সাহায্য নিতে হবে। এতে নতুন অভিজ্ঞতা ও নিরাপদ যাত্রা হবে।

ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই এলাকা হঠাৎ করেই পরিচিতির শিখরে উঠতে শুরু করেছে। পরিচিতির কারণ, এই এলাকায় রয়েছে অগণিত পাহাড়ী ঝর্ণা। স্থানীয়রা এসব ঝর্ণার মর্ম না বুঝলেও পর্যটকদের ঘন ঘন উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এসব ঝর্ণার মূল্য কতটুকু। স্থানীয়দের মতে, পাহাড় থেকে নেমে আসছে পানি, এ আবার দেখার কী আছে? কিন্তু মাত্র ২/৩ বছরের ব্যবধানে আর পর্যটকদের অবস্থানের কারণ এখন ধারণা ক্রমশ পাল্টাচ্ছে স্থানীয়দের।

হিম শীতল পানির ছরা দিয়ে ঝর্ণার গন্তব্যে পৌছাতে অনেক মনোরম। তবে যারা পানিতে পা ভেজাতে রাজি নন তারা মাটির মেঠোপথ ধরে পাহাড়ের কোলে কোলে যাওয়াটাই উত্তম। আর যারা পানিকে ভালবাসেন তারা পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল টিপে টিপে ছরার পথ ধরে চলাটাই যেন আরামের। এপাশ ওপাশ করে ছরার দু’কূল দিয়ে যেন মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ী জনপদ। পাহাড়ী মাটির নুড়িগুলো আস্তে আস্তে পাথরে পরিণত হবার বিষয়টিও আঁচ করতে পারবেন।

দল বেধে গেলেই মজাটুকু একটু অন্যরকম। হৈ হুল্লোড় করে পানিতে থপাস থপাস পথ চলার শব্দ যেন অনেকদূর থেকে ভেসে আসবে কানে। তখন নিজের কাছেও মনে হবে একই ভাবে পথ চলতে।

একটু সামনে গেলেই পাহাড়ের একটি ধাপে কাঁঠাল বাগান জুমা মসজিদ। মসজিদের আশপাশ এলাকা নিয়েই কাঁঠাল বাগান গ্রাম। পাহাড়ের আড়ালে আবডালে ছোট ছোট বসতি। ছরা দিয়ে যাওয়ার সময় হাতের বাঁ দিকে তাকালে দেখবেন বড় বড় পাথরের ভাঁজে ভাঁজে ঝর্ণার পানি বয়ে আসছে। গাঁয়ের বধুরা সেই পানি কলসি ভরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। আর ডান দিকে গেলেই পাবেন ঝর্ণা। ছরা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ৩০/৪০ ফুট উচ্চতা থেকে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার পানি পড়ছে এমন দৃশ্যও চোখে পড়বে। তবে ঝুঁকি রয়েছে এমন পথ চলায়। কারণ হাঁটা চলা একুট মনোযোগ দিতে হবে। অন্যথায় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।

এসব ঝর্ণা পুরো সীতাকুণ্ড-মীরসরাইয়ের পাহাড়ী এলাকা জুড়েই রয়েছে। মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া এলাকায় রয়েছে খৈইয়াছরা ঝর্ণা, কমলদহ এলাকায় রয়েছে রুপসী ঝর্ণা, নাপিত্যার ছরা ঝর্ণা ছাড়াও নামে বেনামে ছোট বড় ঘোষিত অঘোষিত আরও কত ঝর্ণা। খৈইয়াছরা ঝর্ণা দেখতে হলে বাসে কিংবা প্রাইভেট গাড়ীতে পৌঁছাতে হবে বড়তাকিয়া বাজার। মহাসড়ক থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় পাড়ি দিতে হয় পাহাড়ের কোল পর্যন্ত। প্রাইভেট গাড়ী হলে সরু রাস্তা ধরে পাহাড়ের কোল পর্যন্ত তথা ছরার কাছাকাছি যেতে পারবেন। এছাড়াও যাত্রী পরিবহনে রয়েছে সিএনজি টেক্সি। জনপ্রতি ১০ টাকা করে ভাড়া নেয় টেক্সিতে। নামতে হবে কাঁঠাল বাগান। ছোট্ট এলাকা জুড়ে গাড়ীর পার্কিং। পার্কিংয়ে প্রতিটি গাড়ীর জন্য ৫০ টাকা হারে দিতে হয়। তবে তা অনেক বেশী এমন মন্তব্য গাড়ী চালকদের।

গাড়ী কিংবা পায়ে হেঁটে পৌছানোর পর চোখের সামনে পড়বে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে টিনের চালা দোকান। ফ্রিজের ঠান্ডা পানিয়জল তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে খাবারও মেলে। সেখানে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে পাহাড়ী বাঁশের ছোট লাঠি। এছাড়াও প্লাস্টিকের জুতো, শর্ট প্যান্টসহ র‌্যাপলিং ও জুমারিং এর নানা উপকরণ ও সরঞ্জাম । এসব কেনার প্রয়োজন রযেছে অত্যধিক। পাহাড়ের চূড়ায় থাকা ঝর্ণা দেখতে হলে পাহাড়ে উঠতে হবে লাঠির সাহায্যে। কারণ যারা আগে কখনও পাহাড়ে উঠেননি তাদের জন্য বিশেষ করে এই লাঠি খুবই প্রয়োজন। এছাড়া ঝর্ণার পানিতে গোসল করে আসা পর্যটকদের গায়ের কাপড়ের ভেঁজা পানিতে হেঁটে চলার পথটুকু প্রতিনিয়ত পিচ্ছিল থাকে।

দোকানটি অতিক্রম করে একটু সামনে গেলেই খৈইয়ারছরা ঝর্ণার প্রবাহিত কোমল পানির ছরার ওপর দিয়ে পারাপারে কাঠের সাঁকো লাগানো হয়েছে। সাঁকো পার হলেই আবারও পাহাড়ের ঢালু জমিতে আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘেঁষেই যাত্রা শুরু করতে হবে। আবারো প্রায় ২/৩ কিলোমিটার উঁচু নিচুতে ।

এছাড়াও সরকারের অনুন্নয়ন খাত হিসেবে খ্যাত দীর্ঘ মেয়াদী একটি বাগানও চোখে পড়বে পর্যটকদের। ২০০৮-০৯ সালের দীর্ঘমেয়াদী এই বাগানটি বড়তাকিয়া বিট হিসেবে খ্যাত। এর আয়তন প্রায় ১০ হেক্টর। কুন্ডের হাট ব্লকের বারৈয়াঢালা রেঞ্জের আওতায় পড়েছে এই বিশাল পাহাড়ী বনভূমির অবস্থান। গর্জন, ঢাকিজাম, লুম্বক, চিকরাশি, গামারী, আমলকি ও কাঁঠাল গাছসহ নানান প্রজাতির গাছ রয়েছে। চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় থাকা এই বনবিট যেন সবুজ অরণ্যে ঘেরা।

কিছুদূর যাওয়ার পর ঝর্ণার একটি ধাপ পাওয়া যাবে। এই ধাপটির উচ্চতা প্রায় ৩০/৪০ ফুট। এই ধাপ পার হতে হলে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পথ ধরে উপরে উঠতে হবে। তবে সাবধান! খুবই ঝুকিঁপূর্ণ পথ। কেউ কেউ এই ধাপের নীচে থাকা জমানো পানিতে ডুব দিয়ে শীতল পানির পরশ নিচ্ছে। আবার কেউবা ঝর্ণার বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানিতে শুয়ে শুয়ে ছবি তুলছেন অনেকেই।

আবারো ঝর্ণার পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কখনো ঝর্ণার জলরাশি মাড়িয়ে আবার কখনোবা পাহাড়ের উঁচু নিচু ঢাল মাড়িয়ে অবশেষে পরিপূর্ণ ঝর্ণার কাছে পৌছে যাবেন।

স্থানীয়রা সেখানে গত ২/৩ বছরে বেশকিছু দোকানপাট ও খাবার হোটেল তৈরী করেছে। এসব হোটেলগুলোতে পর্যটকরা ঝর্ণা দেখতে যাবার সময় এসব হোটেলে খাবারের ম্যানুটা বলে কিছু টাকা অগ্রিম দিলেই তৈরী করে দেন। এছাড়া ঝর্ণায় গোসলের পর আবার এসব হোটেলে এসে টয়লেটসহ গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে। ঝর্ণা থেকে ফেরার পথে পড়বে খোলা আকাশের নীচে মাত্র ৫ টাকায় ঝর্ণার পানি দিয়ে তৈরী পাহাড়ী লেবুর শরবত, নুডল্স ও সবজির বড়া। বাঁশের খুঁটিতে সাঁটানো আছে অনেক কষ্টে লেখা হোটেলের সাইনবোর্ড। স্থানীয় নুর হোসেনের পরিচালনায় কাঁঠাল বাগান এলাকায় রয়েছে হাঁস মুরগী গরু ছাগলের ছবিতে মায়ের দোয়া হোটেল। তবে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন খাবারের দামও লেখা রয়েছে। একই মালিকের রয়েছে নুর হোসেন স্টোর। গাড়ী পাকিং লাগোয়া রয়েছে নুর জাহান হোটেল। কাঠ মিস্ত্রী ফেরদৌস ও তার স্ত্রী মর্জিনা মিলে টং হোটেল খুলে বসেছে। এই হোটেলে খাবার দাবার ছাড়াও পাহাড়ে বা ঝর্ণায় যেতে চিকন বাঁশের লাঠি পাওয়া যায় মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে। তবে আপনি যদি ফেরার পথে লাঠি ফেরত দিতে চান তাহলে ৫ টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস রয়েছে।

বাংলাধারা/এফএস/এআই

আরও পড়ুন