২৬ অক্টোবর ২০২৫

অসুস্থ মানুষ কিংবা সুস্থ পৃথিবী

ফাহিম আল সামাদ»

‍‍কম্পাস অনুসারে যেটাকে পূর্ব দিক বলে; সেই দিক বরাবর একটি নীল রঙা দালান আছে। দালানের স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো হলেও সময়ের স্রোতে কিছু স্থানে ক্ষত হয়েছে, তবে মলম পট্টি কেন করা হয় নি তা আমার অজানা৷

যাই হোক, ছাদে দাঁড়িয়ে ভোর বেলা এই ক্ষত বিক্ষত দালান দেখতে আমার বেশ চমৎকার লাগে৷ মাঝে মাঝে প্রাগৈতিহাসিক একটি চিড়িয়াখানাও মনে হয়। এই দালানের পাশ ঘেঁষেই প্রতিদিন সূর্য ওঠে। সূর্যের পাশ দিয়ে আমার প্রিয় পাখি; কাক উড়ে যায়। কাকগুলো দূর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর আমি বাতাসের সাথে কথা বলি।

আজকাল বাতাস ভালো আছে,জানিয়েছে পৃথিবীর চারপাশে সে নির্মল থেকে আরও নির্মল হয়ে উঠছে। বাতাসের সুহৃদ ভ্রাতা জলও আজকাল ধীরে ধীরে পরিশুদ্ধ হচ্ছে বলেও টেলিগ্রাম এসেছে। প্রকৃতি মায়ের সকল সন্তানেরা গত দেড় বছর ধরে চমৎকার রকম জীবন যাপন করলেও মনুষ্য এর বাইরে।

সন্তান মায়ের অবাধ্য হলে মা শাস্তি দেয়, তাই প্রকৃতি মা’ও তার মনুষ্যরূপ সন্তানদের শাস্তি দিচ্ছেন। একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস আজ মনুষ্যের মাথার উপর দুঃস্বপ্নের মত ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান,যাদেরকে প্রকৃতি মা অনেক বছর ধরে আগলে রেখেছেন; হঠাৎ তাদেরকে এমন দুঃস্বপ্নের দিনে কেন ফেলে দিয়েছেন তা মনুষ্য বুঝতে পারছেনা। যদিও এতে অন্যান্য সন্তানরা যথেষ্ট লাভবান হয়েছে।

প্রকৃতি মায়ের এমন ক্রোধের কারণ জানতে আমি নীল রঙা দালানের কাছে ফিরলাম। ছোট ছোট খোপ খোপ আটটি ঘরে বত্রিশজন মনুষ্য বসবাস করে এই দালানে। 

ওপর থেকে প্রথম ঘরের কামাল সাহেব বেকার হলেও প্রতিদিন নিয়ম করে গুনে গুনে ১২টি সিগারেট ফুঁকেন। তার পাশের ফ্ল্যাটের ইয়াসমিন বেগম খুব গোপনে দালানের পেছনের দিকে খোলা মাঠে নিত্যদিনের আবর্জনা ফেলেন। তার নিচের ফ্ল্যাটের সুলতানা আপা তার মোডিফাইড গাড়ির ধোঁয়া উড়িয়ে প্রায়ই শহর ঘুরতেন। তৃতীয় তলার ইকবাল আঙ্কেলের পাহাড় কাটার ব্যবসাও রমরমা সাথে ইউসুফ সাহেবের ইটকলের ব্যবসা যেটা লোকালয়ের কাছেই। সুলতানা আপার পাশের ফ্ল্যাটে গেলেই আব্দুর রহমান স্যারের শিকার করা পশুদের চামড়ার আর্ট দেখা যায়। আর এই দালানের মালিক ফারুক আঙ্কেলের পুকুর ভরাট করা বাড়ি এবং তার ছেলের প্লাস্টিক ব্যাগের কারখানা যেন অপূর্ব কোনো সৃষ্টি।

তারা প্রকৃতি মায়ের এত ভালো রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন তাও কেন মা তাদের এভাবে বন্দী করেছেন তার উত্তর দালানও দিতে পারছেনা। তবে গত দেড় বছরে তার ভেতর কয়েদ এই মনুষ্যদের কার্যবলি আর হাহাকার তাকে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে বলেই জানিয়েছে। 

একটি ছোট্ট ম্যাগপাই আমার কানে কানে জানিয়ে দিল সে সাগর ঘুরে এসছে। ডলফিনের চলাচল তাকে মুগ্ধ করায় সে তার সহধর্মিণীর সাথে সেখানে মধুচন্দ্রিমায় যেতে চায়। আমি তাকে অভ্যর্থনা দিতে দিতে ভাবলাম পাশের বাড়ির আম গাছের ডালে সে আমার প্রতিবেশী ছিল একসময়। আমার আরেক প্রতিবেশী মিজান সেই ম্যাগপাইয়ের বাড়ি ভেঙে দেওয়ার পর সে অন্যত্র চলে গিয়েছিল,এখন আবার সে ফিরে এসে সবাইকে তার ভ্রমণের সংবাদ জানিয়ে আনন্দ নিচ্ছে। 

বেলা গড়াতে শুরু করলে বাতাস আবার ফিরে আসলো; জানানো সে অনেক প্রফুল্ল। কারণ জানতে চাইলে সে বলব আজ মেঘের সাথে চুক্তি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির আগমন হবে। খেয়াল করে দেখলাম দালানের সাথে আলাপের সময়ই আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি তৈরী হচ্ছে, সে নামবে।

বহুদিন পরিশুদ্ধ বৃষ্টিতে ভিজি না। করোনা নামক মহামারীর কবলে পড়ে গৃহবন্দী হওয়ার আগে একবার দূষিত বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছিলাম। আজও ভিজবো কিন্তু এই বৃষ্টি স্বচ্ছ। এই বৃষ্টিতে কোনো দূষণ নেই, কেবল প্রকৃতি মায়ের স্নিগ্ধ ভালোবাসা আছে। বৃষ্টির কোমল স্পর্শ মুখে লাগে, তারপর বর্ষণ। ধুঁয়ে যেতে থাকে সকল দূষণ, নির্মল হতে থাকে চারপাশ। আমি দু’চোখ বুজে ভিজতে থাকি পরম আনন্দে। 

আমি এখনও উত্তর পাই নি। মনুষ্য সন্তানের প্রতি প্রকৃতি মায়ের ক্রোধের কারণ এখনও জানা হলো না। তবে অন্যান্য সন্তানদের প্রতি যে তিনি কোমল, তা আমি ভালোই জেনেছি। আর তাই আনমনেই আমি বলে উঠি “পৃথিবী ঠিকই ভালো আছে”…

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন