২৩ অক্টোবর ২০২৫

রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

রোহিঙ্গা ক্যাম্প জুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৪৭ রোহিঙ্গার ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার খবরে সচেতন মহলে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। আক্রান্তের মধ্যে গেল এক মাসে শিশুসহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। গত দু’মাসে এর প্রকোপ বেড়েছে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মশার কামড় থেকে নিজেদের রক্ষা না করায় ক্যাম্পে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এটা ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে ক্যাম্পের বাইরেও। এ অবস্থায় ব্যাপক আকার ধারণ করার আগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয়দের সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণার পাশাপাশি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ এবং এনজিও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যান বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়সহ জেলায় ১ হাজার ৮৯ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। রোহিঙ্গা ছাড়াও সনাক্ত হওয়া স্থানীয় ১৪২ রোগীর মধ্যে উখিয়া ৬০, টেকনাফ ৬৭, কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৬, মহেশখালী ১, চকরিয়া-১ রামু-৩ এবং অন্যান্য উপজেলায় ৪ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫০১ জন সুস্থ হয়ে ফিরলেও মৃত্যুবরণ করেছে শিশুসহ তিন রোহিঙ্গা।

তারা হলেন, ছুফিয়া খাতুন (৫০), ছয় বছরের শিশু নুরুল হক এবং তাহমিদা (২৬)। তিনজনই ১৬ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে মারা যান।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্র জানায়, রবিবার (১২ ডিসেম্বর) হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন ১১ জন। তাদের সিংহভাগই রোহিঙ্গা।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোহিঙ্গা কবির আহম্মদের স্ত্রী বেদু (৪৫) বলেন, জ্বর আর ব্যাথা নিয়ে আইওএম হাসপাতাল থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গেল ১২ দিন ধরে সেবা নিচ্ছি। কিছুটা পরিবর্তন হলেও কবে সুস্থ হবো জানি না। তিনি হাসপাতালের নারী ওয়ার্ডে ৩ নং সীটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ক্যাম্প-২ এর বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের কন্যা তসলিমা (১৯) বলেন, জ্বর আসার পর প্রথমে কুতুপালংস্থ ‘জিকা হাসপাতালে’ গেলে তারা ‘আইওএম’ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখানে একদিন সেবা নেয়ার পর কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে সেবা পাঠায়। শরীর আগের চেয়ে একটু ভাল।

ক্যাম্পে কর্মরত ‘জাগরণ নারী ফাউন্ডেশন’ এর কর্মকর্তা স্মৃতি কণা তালুকদার বলেন, চাকুরিরত অবস্থায় গায়ে জ্বর আসলে আমি হাসপাতালে আসি। টেষ্ট করার পর ডেঙ্গু ধরা পড়লে চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি দেন। চারদিন সেবা নেয়ার পর রবিবার হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন।

উখিয়ার রত্নাপালং এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার নামে এক রোগীর অভিভাবক দিলুয়ারা বেগম বলেন, ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফিরে গায়ে জ্বর অনুভব হলে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায়। ডেঙ্গু সনাক্ত হলে উখিয়া হাসপাতালেই ভর্তি দেয়া হয়। কিন্তু রোগীর অবস্থার অবনতি হলে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করে। এখানে আসার পর প্রচুর বমি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গ জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। যা এডিস ইজিপ্টি মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। স্বল্প জমিতে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বসবাস করার ফলে দ্রুত এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। যদি এখনই প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হয় তবে এ রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের অজ্ঞতা আর মশা নিয়ন্ত্রণে দুর্বল ব্যবস্থার কারণেও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা।

এদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত চাকুরিজীবীদের মাধ্যমে স্থানীয়দের মাঝেও ক্রমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রনজন বড়ুয়া রাজন জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সন্দেহজনক জ্বরের রোগীকে স্ক্রিনিংয়ের (রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া) আওতায় আনতে হবে। এবং আবশ্যিক ভাবে ডেঙ্গু বিস্তারকারি বাহক (এডিস মশা) নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া দরকার।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, স্থানীয়রা সচেতন না হলে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রচেষ্টায় সুফল আসবে না। তাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ মশা যেন প্রজনন ঘটাতে না পারে সেজন্য বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, ডাবের খোসায় জমানো পানি এবং ডোবায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখতে হবে।

ঢাকা থেকে এ রোগ কক্সবাজারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি করে কক্সবাজার সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তৎমধ্যে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে পৌর প্রশাসন, বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সচেতনতা মূলক কার্যক্রম চলছে। একই সাথে জনগণকে সচেতন করতে গঠন করা হয়েছে মেডিকেল প্রচারণা টিমও।

তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সাথে কাজ করছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। ইতিমধ্যে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের সচেতন করার পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এক কথায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ চলমান রয়েছে বলে জানান ডা. আলমগীর।

সাধারণ মানুষকে আতংকিত না হয়ে আরো বেশি সচেতন হওয়ার আহবান জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, দিনেই এডিশ মশা কামড়ায়। তাই দিনে মশার আক্রমন থেকে বাঁচতে পরিবারেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে পদক্ষেপ নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

আরও পড়ুন