২৮ অক্টোবর ২০২৫

ভোজন রসিকদের শুঁটকি মেন্যু

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

শুঁটকি নেই কোথায়, চট্টগ্রামের যত্রতত্র শুঁটকির যেমন দোকান আছে তেমনি রয়েছে শুঁটকির মেন্যুকে ঘিরে সুসজ্জিত হোটেলের বুফে তালিকাও। সুস্বাদু এ শুঁটকির কদর শুধুই দেশেই নয়, বিদেশেও জমেছে। প্রবাসীরা চট্টগ্রাম এলেই ফেরার পথে নিয়ে যায় চট্টগ্রামের অতি প্রাচীন তালিকার এই শুঁটকি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকির তরকারি বিলাসবহুল হোটেলেও ক্রেতার অপেক্ষায় থাকে। শুঁটকির ভর্তা, চর্চরি আর সাদা ভাতে দুপুরের খাবারে আত্মতৃপ্তি। ভোজন রসিকের মন যেন তৃপ্তিতে ভরে উঠে। জিভে জল আসে চাঁটগাইয়া শুঁটকির কথা শুনলে অনেক ঢাকাইয়্যারও। শুধু রাজধানীই নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেড়াতে আসারা পুটলি বেঁধে নিয়ে যায় নানা জাতের শুঁটকি।

চট্টগ্রামে শুঁটকি হাতের নাগালে। শুধু বাজারেই নয়, ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে সচরাচর চোখে পড়ছে শুঁটকির পসরা। দিনের শেষলগ্নে বিশেষ করে অফিস ছুটির সময়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়গুলোতে ভাসমান বিক্রেতারা পসরা নিয়ে বসেন। বাজারের তুলনায় এসব দোকানিদের কাছে দামও অনেক কম।

নগরীর কর্ণফুলী নদী ও চাক্তাই খাল কেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি নিয়ে পসরা বসান। জমিয়ে তোলা হয় শত আইটেমের শুঁটকির পসরা। চারদিকে শুঁটকি আর শুঁটকি।

দোকানির যেমন অভাব নেই ক্রেতারও ভিড় ঠেলে চাহিদা মাফিক শুঁটকি কেনা অনেকটা দায় হয়ে পড়ে। তবে দোকানিরা রাতের আঁধারকে অনেকটা পছন্দ করেন। এর মূলে রয়েছে নতুন ক্রেতাদের ঠকানোর প্রক্রিয়া। যারা কখনো শুঁটকি কেনেননি তারাই মূলত ঠকতে পারেন। শুঁটকি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলে ভেজা শুঁটকি ওজনে যেমন বাড়বে, তেমনি স্বাদেও ব্যতিক্রম থাকবে। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে একটু সচেতন হলেই অর্থাৎ শুকনো শুঁটকি তবে বেশি পুরাতন নয় এমনটাই জিভের স্বাদ মেটাতে পারবে।

নগরীর নামিদামি হোটেলের মেন্যুতে শুঁটকির ভর্তা স্থান করে নিয়েছে ক্রেতাদের চাহিদার কারণে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি হতদরিদ্র শ্রেণীও সপ্তাহের কোন না কোনদিন শুঁটকির তরকারির মেন্যুতে সাজায় দুপুরের বা রাতের খাবার। নগরীর বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে বুফে খাবারে কয়েকটি আইটেম থাকে শুঁটকির ওপর। এরমধ্যে রয়েছে সিম আর শুঁটকির ভর্তা, শুঁটকি আর আলুর ভর্তা, বেগুন আর শুঁটকির চর্চরি।

চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশিরভাগ তরকারিগুলো রান্না হয় শুঁটকি নির্ভর। এমনও দেখা গেছে, বিত্তশালী পরিবারে গরুর মাংসের সঙ্গে কোরাল শুঁটকির রান্না। যারা খাননি তারা তরকারিটি মুখরোচক হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবতারণায় থাকেন। আর যারা চেখে দেখেছেন তারাতো স্বাদই নিয়েছেন। দুইয়ের মধ্যে তফাৎ ভারতীয় হিন্দী ভাষার সেই ডায়ালগ ‘জোবি খায়েগা তো নেহি পস্তায়গা, জোবি নেহি খায়েগা তো বি পস্তায়গা’।

চট্টগ্রামে শুঁটকির বাজার হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম স্টেশন সংলগ্ন রেয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, পাহাড়তলী বাজার, হালিশহর ফইল্যাতলী বাজার, কর্ণফুলী বাজার, কাজির দেউড়ি বাজার, ইপিজেড বাজার, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার, পতেঙ্গা নারিকেল তলা বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজারে শুঁটকির দোকান সবচেয়ে বেশি। তবে চাক্তাই হচ্ছে শুঁটকির সবচেয়ে বেশি যোগানের অধিকারী। এক কথায় চাক্তাইকে শুঁটকির খনি বলা হয়।

পাইকারি ও খুচরা বাজার হিসেবে আসাদগঞ্জ ও চাক্তাই দেশব্যাপী পরিচিত। এসব বাজারে চট্টগ্রামের সেন্টমার্টিন দ্বীপ অঞ্চল থেকে শুরু করে কুমিরা সাগর পাড় পর্যন্ত সব উপকূলীয় অঞ্চলের শুঁটকির যোগান দেয়া হয়। এরমধ্যে চরলক্ষ্যা, কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, রাঙ্গাবালি, টেকনাফের সাহাবুদ্দিয়া, বাঁশখালির উপকূল অঞ্চল, ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট ও ছোট এবং বড় কুমিরা থেকে শুটকীর যোগান দেয়া হয় এসব বাজারে।

জিভে পানি আসা শুঁটকির মধ্যে রয়েছে লইট্যা, ইলিশ, কোরাল, চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাক্কাসহ কয়েক প্রজাতির শুঁটকি। এছাড়াও ছুরি শুঁটকি, মইল্যা, কেচকি, পোয়া, ফাইস্যা, পিতল শুঁটকিসহ নানা প্রজাতির ছোট শুঁটকি প্রতিনিয়ত তরকারিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে সুস্বাদু হয়ে উঠে শুঁটকির স্বাদে।

চট্টগ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুঁটকি ছাড়া কোন তরকারি রান্না করা হয় না এমন রেওয়াজ রয়েছে। তবে যারা চট্টগ্রামে বসবাস করেন তাদের অনেকেই এখন শুঁটকি নির্ভর হয়ে গেছেন। বিশেষ করে নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের লোকজন যারা দীর্ঘ সময় চট্টগ্রামে রয়েছেন তারাও চাটগাঁইয়াদের হাল ধরেছেন। যেন মনে হয় শুঁটকি ছাড়া খাবার সুস্বাদু হবে না। আর শুঁটকির ভর্তায় সাদা ভাত যেন অধিক পরিমাণে খাওয়া যায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরিবারগুলোতে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজারে কমপক্ষে সহস্রাধিক দোকানি রয়েছে শুঁটকি ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। বিত্তশালীদের নজর কাড়ে লাক্কা আর কোরাল শুঁটকি। চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরেও ৭/৮ কেজি ওজনের লাক্কা শুঁটকি বিক্রি হয়। এছাড়াও কোরাল শুঁটকি পাওয়া যায় আড়াই থেকে ৩ হাজার দরে। রূপচাঁদা রয়েছে ১৪শ থেকে ১৮শ টাকা কেজিতে। লইট্যা শুঁটকি ৬/৭শ টাকা, ছুরি শুঁটকি ৩শ থেকে ৫শ টাকা। চিংড়ি শুঁটকি বিক্রি ৭/৮শ টাকায়। তবে ছোট জাতের চিংড়ি বা পুইস্যা গুড়া বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪শ টাকা কেজিতে। ফলে শুঁটকি কদর কমছে না, বরং বাড়ছে।

আরও পড়ুন