২৫ অক্টোবর ২০২৫

মেঠোপথের শিল্পী আবদুল গফুর হালী

মুহাম্মদ আব্দুল আলী »

বাংলা লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্রগুলো রূপায়িত হয় এ লোকসঙ্গীতে। আমাদের দেশে যে সমস্ত লোকশিল্পী লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে আবদুল গফুর হালী একজন কিংবদন্তী লোকসঙ্গীত শিল্পী।

তিনি চট্টগ্রামের সংগীত ধারা আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানের কীর্তিমান শিল্পী। তিনি একাধারে বাংলার ভাবজগতের কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও নাট্যকারও। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী, মুর্শিদি, মারফতি প্রভৃতি ধারার গান রচনা করেন।

প্রায় দুই হাজারেরও অধিক তাঁর রচিত গানের সংখ্যা। অধিকাংশ গানের তিনি নিজেই সুর করেছেন। তাছাড়া তিনি একাধিক নাটকও রচনা করেন। শুধু চট্টগ্রামেই নয়, দেশে-বিদেশেও তাঁর লেখার ওপর আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

আবদুল গফুর হালীর জন্ম ১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদে। বাবা আবদুস সোবহান এবং মা গুলতাজ খাতুন। লেখাপড়া করেছেন রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে।

রশিদাবাদ গ্রামের প্রখ্যাত সাধক শিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের আধ্যাত্মিক ও মরমী গানে গফুর হালী গভীরভাবে প্রভাবিত হন। সে সময়ে লেটোর দল, যাত্রাদলের আনাগোনা, পালা গান, গাজীর গান, পুঁথি পাঠের আসর বসত ঘরে ঘরে। গফুর হালী এসব আসরের নিয়মিত শ্রোতা ও দর্শক ছিলেন। সেই থেকে গান করা, গান লেখার প্রতি তাঁর ঝোক।

গফুর হালীর লেখা গানের মধ্যে ‘সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে’, বানুরে অ বানু আই যাইয়ুম গই চাটগাঁ শরত তোঁয়ার লাই আইন্যম কী’, কিংবা মাইজভাণ্ডারী গান- ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে’, ‘মাইজভাণ্ডারে কি ধন আছে’, ‘কতো খেলা জানরে মাওলা’ প্রভৃতি অন্যতম।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী জুটি শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় অসংখ্য গানের স্রষ্টা গফুর হালী। তিনি ছয়টি আঞ্চলিক নাটক রচনা করেন। তাঁর রচিত আঞ্চলিক নাটকগুলো- গুলবাহার, নীলমণি, কুশল্যা পাহাড়, চাটগাঁইয়া সুন্দরী, সতী মায়মুনা ও আশেক বন্ধু। এর মধ্যে ‘গুলবাহার’ গীতিনাট্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চায়িত ও বেতার-টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।

আবদুল গফুর হালীর মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণামূলক বই বেরিয়েছে। জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষ বিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সাবেক সহকারী অধ্যাপক বর্তমান হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হানস হারডার ১৯৮৯ সালের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

তিনি চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স’ান পরিদর্শন করেন এবং তখনই গফুর হালীর সাথে যোগাযোগ হয় তাঁর। গফুর হালীর জীবন ও গান নিয়ে ড. হানস হারডারের লেখা ‘ডার ফেরুকটে গফুর, স্প্রিখট (পাগলা গফুর, বলেন)’ নামের গবেষণা গ্রন’টি ২০০৪ সালে প্রকাশ করেন। এতে গফুর হালীর ৭৬ টি গান অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রন’টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

তাঁর গান নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে দু’টি গবেষণাগ্রন্থ’ প্রকাশ করেছে। সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় ‘সুরের বন্ধু’ ও মোহাম্মদ আলী হোসেনের সম্পাদনায় ‘শিকড়’ নামে এ দু’টি গ্রন’ প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মিত হয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মেঠোপথের গান’।

এ কিংবদন্তী শিল্পী ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর (৮৭ বছার বয়সে) ভোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রেখে যাওয়া ভাবসম্পদ আমাদের সংস্কৃতির মূলধারা। কারণ তিনি বাংলার জনসমাজের ভেতর থেকে উঠে এসেছেন। জনসমাজের ভাব-ভাষা, চেতনাপ্রবাহ, জীবনাচরণের চিহ্ন তাঁর কথা আর সুরে গেঁথে আছে। যেখানে ধর্ম-বর্ণ, জাতপাত ও ভেদাভেদ নেই। যার মাধ্যে আছে মানবধর্ম, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও বৈষম্যহীন সুন্দর সমাজের কথা।

গফুর হালী বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। তিনি অমর ভাবসাধক। আজীবন তিনি মানব মুক্তির গান করে গেছেন। এ মহান জাতশিল্পীর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

এদিকে আবদুল গফুর হালীর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে আজ মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে ‘আলোচনা সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান’র আয়োজন করেছে ‘আবদুল গফুর হালী রিচার্চ সেন্টার’।

লেখক : সহ-সম্পাদক, বাংলাধারা ডটকম

আরও পড়ুন