মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »
পঙ্গুত্ব হার মানাতে পারেনি এক দেশপ্রেমিককে। পঙ্গুত্বের কাছে হার না মানা এক মুক্তিযোদ্ধার অবদান রয়েছে আমাদের বিজয়ে। পঙ্গুত্বের অভিশাপও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মুছে দিয়েছেন তিনি। শুধু বিজয়েই ক্ষান্ত হননি, লিখেছেন এ পর্যন্ত ৬টি বই। আগামী শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘অশ্রুমালা’ নামের ৬ষ্ঠ বইটির মড়োক উম্মোচন করা হবে আনুষ্ঠানিকভাবে। বাংলা একাডেমি অথবা একুশে পদক পেতে এবার আবেদন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা আফসার উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী। এ পদকটি পেলে তাঁর সর্বশেষ আশা পূরণ হবে বলে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে জানিয়েছেন।
এলাকায় প্রতিবন্ধিতার অভিশাপ যেন অন্যের ঘাঁড়ে আর না চাপে সে জন্য তিনি ‘ব্রাইট ডিজএ্যাবল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এ প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ৬০। দেশি-বিদেশি কোন অনুদান না থাকলেও স্থানীয়দের সহায়তায় চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত তিনি অনেককে পঙ্গুত্বের অভিশাপ মুক্ত করতে মোহরাস্থ এ কে খান গ্রুপের মালিকানাধীন সিপিএ হাসপাতাল থেকে ৩০ জনকে কাঠের তৈরি পা লাগিয়ে দেয়ার সুযোগও করে দিয়েছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের গোয়েন্দা সৈনিক আফসার উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র চার বছর বয়সে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্বের কাছে হার মানেন মুক্তিযুদ্ধের গোয়েন্দা সৈনিক আফসার উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী। ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফটিকছড়ির দৌলতপুর গ্রামে দায়েম চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা সাবেক সেনা কর্মকর্তা মৃত বাদশা মিয়া চৌধুরী ও মাতা মৃত জাহানারা বেগম। পিতামাতা হারা হলেও পঙ্গুত্ব নিয়ে দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে চলেছেন এই গোয়েন্দা সৈনিক।

প্রতিবন্ধী জীবনের আগের সোনালী দিনগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫৪ সালের ৭ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র চার বছর সাতদিন তিনি কাটিয়েছেন আট-দশজন মানুষের মত। কিন্তু এরপর টাইফয়েডে তিনি গ্রাম্য ডাক্তারের অপচিকিৎসায় পঙ্গুত্বের কাছে হার মানেন। তবে জ্ঞানের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি। ফলে যে কোন স্থানে যে কোনভাবে যা কিছু অর্জন করা যায় সবই যেন নিজের কাছে টেনে আনার অক্লান্ত চেষ্টা ছিল তাঁর।
১৯৭০ সালে ফটিকছড়ির কাটিরহাট চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) মানবিক বিভাগ থেকে ফাস্ট ডিভিশনে উত্তীর্ণ হন। প্রতিবন্ধিতার অভিশপ্ত জীবন ভর করতে পারেনি শিক্ষা জীবনে। ১৯৭১ সালে যখন পাকিদের কাছ থেকে দেশ রক্ষায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
দেশ মাতৃকার টানে পাক হানাদারদের কাছ থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষায় তিনিও পঙ্গুত্বের অভিশাপ কোলে নিয়ে গোয়েন্দাগিরিতে মত্ত হন। গোয়েন্দা সদস্য হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন ওই এলাকার সন্তান হিসেবে। তার কাজ ছিল পাকিদের গোপন তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছে দেয়া। পঙ্গু হওয়ার কারণে তখন তাকে পাকিরাও সন্দেহের চোখে দেখত না। তিনি তখন হুইল চেয়ারে নয়, হাতে কাঠের জুতো ও হাঁটুতে রাবারের টুকরো লাগিয়ে চলাচল করতেন। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন স্থানে পৌঁছে দিতেন খবর। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পেলেও শেষ পর্যন্ত তা হারিয়ে ফেলেছেন।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অদম্য উৎস ও সাহস নিয়ে অবশেষে নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ৭৫’ সালে একই বিভাগ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রীও লাভ করেন। চেষ্টা করেছিলেন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করার। পারিবারিক অনটন আর শারীরিক প্রতিবন্ধিতা তাঁর সে আশাটুকু পূরণ করেনি। বাবা আর্মি সুবেদার আলহাজ্ব বাদশা মিয়া পড়ালেখার ব্যয় বহন করতে না পারায় চাকরির চেষ্টা করেও পঙ্গুত্বের অভিশাপে তাও জোটেনি।
মাতৃভূমি দৌলতপুরেই গড়ে তোলেন শাপলা কোচিং সেন্টার নামে একটি শিক্ষাকেন্দ্র। এ থেকে আয়ের পথটি খুললেও অভিশপ্ত জীবনে আর আশার আলো দেখার সুযোগ ছিল না। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক দানবীরের সহায়তায় ঢাকার মহাখালীস্থ মোহাম্মদপুর জাকির হোসেন সড়কে বিহারীদের একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে কোচিং সেন্টার খুলেন। সেখানে ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হত। এ অবস্থায় পার করেছেন চার বছর। এদিকে, ’৮৫ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঢাকায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

তিনি এ পর্যন্ত ১৭টিরও বেশি বই, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, গল্প লিখে ফটিকছড়ির মানুষের কাছে চির চেনা হয়েছেন। ২০১১ সালে সাহিত্য ও গবেষণায় মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন স্মৃতি পদক লাভ করেছেন তিনি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার উপর লেখা ছাড়াও তার রয়েছে অনেক গবেষণা ও চর্চার পান্ডুলিপি। আর্থিক অনটনের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার লেখা অনেক কবিতা-ছড়ার পাতা। তাঁর এ জ্ঞান চর্চা তুলে ধরতে আকুতি জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির প্রতি। পঙ্গুত্বের কোলে বসে জ্ঞান চর্চার যে অবিরত মজুদ রয়েছে তার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার অথবা একুশে পদক নির্ধারণের বিচারক মন্ডলীর দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছেন।













