সম্পাদকীয়»
ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হলো। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে জীবন উৎসর্গ করার স্মৃতি এ মাসেই সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সংবাদপত্রগুলোতে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষাবিষয়ক লেখালেখি শুরু হয়।
এ ভাষার মাসেই শহীদদের স্মরণে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে করোনা মহামারির কারনে এবারের একুশের অনুষ্ঠানমালায় আনা হচ্ছে পরিবর্তন। একুশের মাসের সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ মাস ব্যাপি বইমেলা এবার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে না। ইতোমধ্যে মেলা দুইসপ্তাহ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। করোনা মহামারির বাস্তবতা বিবেচনা করে এবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সামাজিক ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
আবার এলো ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু হলো আজ মঙ্গলবার। এ দিন থেকে ধ্বনিত হবে সেই অমর সংগীতের অমিয় বাণী ‘আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।’ বাঙালি জাতি পুরো মাসজুড়ে ভালোবাসা জানাবে ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের প্রতি।
ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষকাল।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বস্তুত ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আছে এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি ভাষার জন্য এ মাসে জীবন দিয়েছিল।
ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এর মধ্যদিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বীকৃতির পরবর্তীকালে দেখা গেছে বাংলা সাহিত্যের প্রসারে বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের নতুন নতুন বই লিখতে ও প্রকাশ করতে, বই মেলার প্রচলন হতে, ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটতে। বস্তুত সমাজে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সমাজদেহ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ বা হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আশার কথা আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। আমরা বিশাল বিশাল বাজেট পাস করছি তাও সত্য। কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কি কমেছে? সর্বস্তরে বাংলাভাষা কী চালু হয়েছে? একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রর্বতন ছিল আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। জাতীয় শিক্ষানীতি কী আমরা একমুখী করতে পেরেছি? ভাষার মাসে এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে এ কথা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের বিপুল অর্জনের পাশাপাশি আমাদের ব্যর্থতাও রয়েছে। এই ব্যর্থতা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।