ফেরদৌস শিপন »
সড়কে প্রাণের অপচয় এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোন মুহূর্তে কার প্রাণ যাবে, কেউ বলতে পারে না। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যা বোধসম্পন্ন মানুষের মন দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। মানতে বড় কষ্ট হয়। গতকাল শুক্রবার মিরসরাইয়ে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ তাজা প্রাণের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। নিহত যাত্রীরা মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখে ফিরছিলেন। তাদের আনন্দযাত্রা পরিণত হলো শবযাত্রায়। অমার্জনীয় অবহেলায় এতগুলো তাজা প্রাণ মুহূর্তে ঝরে গেছে। এই অকাল মৃত্যুতে শোকাহত ও ব্যথিত আমরা। এমনই মর্মান্তিক খবর আসে দেশে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিটা দিন।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া স্টেশন এলাকার খৈয়াছড়া ঝরনায় ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে ট্রেনের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো পাঁচজন। যাদের সবাই তরুণ শিক্ষার্থী। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেন ওই মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয়। ট্রেনের ইঞ্জিনটি মাইক্রোবাসকে টেনে প্রায় আধা কিলোমিটার সামনে বড় তাকিয়া স্টেশনের কাছাকাছি এলাকায় নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। নিহতদের সবার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে। খৈয়াছড়া ঝর্ণায় আনন্দ শেষে লাশ হয়ে হাটহাজারীর বাড়ি ফিরতে হলো তাঁদের। শত শত মানুষ দুর্ঘটনাস্থলে এসে চোখের জল ঝরাচ্ছিলেন তরুণ শিক্ষার্থীদের সারি সারি নিথর দেহ দেখে।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের এক কিলোমিটার উত্তরে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো লাইনম্যান ছিলেন না। সড়কের ওপর লেভেল ক্রসিংয়ে ছিল না সিগন্যাল। এ কারণে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই রেললাইনের ওপর উঠে যায় মাইক্রোবাসটি। এতে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসযোগে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে আসেন ওই তরুণ শিক্ষার্থীরা। ভ্রমণ শেষে বেলা পৌনে ১টার দিকে ফেরার পথে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। এই দুর্ঘটনার খবরটি দেশে প্রথম নয়। গণমাধ্যমে এ ধরণের খবর নানা সময়ে উঠে আসে। উঠে আসে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের এমনই দুর্দশার চিত্র।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া এলাকায় প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি হওয়ায় সেখানে সবসময়ই পর্যটকের ভিড় থাকে। উপজেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও সতর্ক থাকা উচিৎ পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে।
এভাবে প্রাণহানি থামাতে যেন কারও দায় নেই। নাহলে রেললাইনের উপরে ১১ জন মানুষের মৃত্যু সংশ্লিষ্টদের নাড়া দিত। মানুষের অকাল প্রয়াণের বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা ধরনের আইন ও নির্দেশনা থাকলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সেগুলো মানা হয় না বললেই চলে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি ও কর্মতৎপরতা বাড়াতে হবে বলে আমরা মনে করি।
আমরা প্রায় সময় দেখি, কোন দুর্ঘটনা ঘটার পরই প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা তৎপরতা শুরু করেন। এমন তৎপরতা আগেই চলমান থাকলে দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। সড়কে এভাবে তাজা প্রাণ ঝরে পড়া রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেসব নির্দেশনা তেমন একটা বাস্তবায়ন করা হয়নি। সেই নির্দেশনা যেমনই চালকবান্ধব, তেমনই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যও কার্যকর। মনে রাখতে হবে যত দিন আমরা সততা, সদিচ্ছা, দায়বোধ থেকে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে না নামব, তত দিন সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির চাকায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে না।
সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়ার বিষয়টি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনানুগ বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি কি গুরুত্ব দেয়া দরকার। এমন তো নয় যে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে এসব নিয়ে কথা বলছেন, সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে, সভা-সেমিনারও কম হচ্ছে না। দীর্ঘদিনের নাগরিক দাবি আইন সংশোধন করে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের শাস্তি বাড়ানোর। সেই আইনও পাস হলো। কিন্তু প্রতিকার নেই। এছাড়া নতুন সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়নও নেই বললেই চলে! এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই এমন দুর্ঘটনা রোধে কঠোর ও যথাযথ নিয়মে তৎপর থাকতে আমরা সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি। দেশের আর কোনো জায়গায় যেন সংশ্লিষ্টদের এমন অবহেলা লক্ষ্যণীয় না হয়। একইসঙ্গে নিহত, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা সহ যাবতীয় ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাধারা