সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
অধুনিক মাদক ইয়াবা ঠেকাতে গতবছরের শুরতেই ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রযন্ত্র। এরপর থেকে ইয়াবার ট্রানজিট পয়েন্ট টেকনাফ ও কক্সবাজার জুড়ে চলছে কড়া অভিযান। এতে প্রতিদিনই ঝরছে ইয়াবায় সংশ্লিষ্ট কোন না কোন কারবারির প্রাণ।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা তালিকায় গডফাদার হিসেবে নাম আসারা এসব অভিযানে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও চুনোপুটিরা কুপোকাত হচ্ছে বেশি। এরপরও থামছে না ইয়াবার প্রসারতা।
কখন নিজের বুকে গুলি বিধছে এ ভয়ে, প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে ইয়াবায় জড়িয়ে রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন হওয়া অসংখ্যজন। তাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে আত্মসমর্পণ প্রস্তাব। প্রশাসন ধারণা করেছিল, তালিকাভূক্তরা আত্মসমর্পণ করলে কমে আসতে পারে ইয়াবা আগ্রাসন।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশ প্রধান ড. জাবেদ পাটোয়ারীর হাতে তালিকাভুক্ত ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণেও কোন সফলতা আসেনি। বরঞ্চ, নিত্য নতুন কৌশলে সীমান্ত পার হচ্ছে ইয়াবার বিশাল বিশাল চালান। হাতে-গোনা কিছু চালান ও বাহক ধরা পড়লেও বিশাল অগণিত চালান নিরাপদে জায়গা মতো পৌছে যাচ্ছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
সূত্র বলছে- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা মতে ৭৩ বড় ব্যবসায়ীর মাঝে ২৪ জন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক সাংসদ বদির চার ভাই আবদুল শুক্কুর, আবদুল আমিন, মো. শফিক ও মো. ফয়সাল, বদির ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল, ভাগনে সাহেদুর রহমান নিপুসহ ১৬ জন।
এছাড়া আছেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়া, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নুরুল হুদা ও জামাল হোসেন, টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর নুরশাদ, নারী কাউন্সিলর কহিনুর বেগমের স্বামী শাহ আলম, টেকনাফ সদর ইউপি সদস্য এনামুল হক, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহর দুই ভাই জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমান। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ২ থেকে ১৬টি মামলা আছে।
অপরদিকে, তালিকার বাকি ৪৯ জনের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ছয়জন। বাদবাকি ৪৩ জনের কেউই আত্মসমর্পণ করেননি। এর মধ্যে তালিকার এক নম্বরে থাকা সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি নিজেও আত্মসমর্পণে যাননি।
তালিকার দুই নম্বরে থাকা সাইফুল করিমও নিরুদ্দেশ। আর বাধাহীন চারপাশ বিচরণ করছেন আরেক আলোচিত গডফাদার জাফর আহমদ চেয়ারম্যান। মাঠে রয়েছেন তার ছেলে টেকনাফ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি শাহজাহান। মাদকের কারবারি নিয়ে গঠিত সব কটি তালিকায় ‘গডফাদার’ হিসেবে আবদুর রহমান বদি ও বদির ৫ ভাই, এক বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম রয়েছে।
যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের সহযোগি হাতগুলো জায়গামতো রয়েছে। তারাই পুরোদমে ব্যবসা সচল রেখেছে।
ইয়াবার আগ্রাসন থামাতে তালিকায় নাম আসা ইয়াবা কারবারিদের মাঝে যারা এখনো জেলের বাইরে রয়েছেন তাদের আবারো আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ চলছে। এবারো শতাধিক আত্মসমর্পণ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আহ্বানে যারা সাড়া দিবেন না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ঘোষণা দেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
কিন্তু শৃংখলা বাহিনীর কিছু ব্যক্তির বিতর্কিত কর্মকান্ড এ উদ্যোগকে পুরোপুরি সফলতা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তালিকাভূক্ত অনেকে ‘বিশেষ বিনিময়ে’ অনুকম্পা পাচ্ছে। আবার অনেক তালিকাভূক্তকে ধরে দেনদরবারের পর কিছু ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়া হচ্ছে। এরমাঝে অনেক নিরহ ব্যক্তিও হয়রানিসহ বন্দুকযুদ্ধে মারাও যাচ্ছে। মারা যাওয়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার কোনো তথ্যও এলাকায় পাওয়া যায় নি বলে অভিমত স্থানীয়দের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে অধিকাংশই চুনোপুঁটি। আত্মসমর্পণ করেনি এমন অন্তত ২০-২৫ জন ইয়াবা গডফাদার এখনো প্রকাশ্যে রয়েছে। আবার আত্মসমর্পণকারিদের সহযোগি ও বাইরে থাকারা পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিরবিচ্ছিন্ন ইয়াবার কারবার চালাচ্ছেন। চারপাশের সহযোগিতায় তাদের ব্যবসা আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে।
আবার অনেকে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিয়ন্ত্রণ করছেন ইয়াবা ব্যবসা। জাহাজ, উড়োজাহাজ এমনকি হেলিকপ্টারেও এখন ইয়াবা পাচার হচ্ছে। তবে, ফিল্মী স্টাইলে বিশেষ কায়দায় পেটে নিয়ে ইয়াবা পাচার করার কৌশলটা সম্প্রতি প্রচার পাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। রাতের আধারে কিংবা ভোরে মিয়ানমারের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয় রোহিঙ্গাদের। ক্ষেত্র বিশেষে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপির সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা ইয়াবার চালান নিয়ে ফিরছে এপারে। অনেকে আবার পেটেও নিয়ে ফিরছে। এভাবে ইয়াবা আনতে গিয়ে বিজিবি ও পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নাফনদীর সীমান্ত পারে নিহত হয়েছে।
সম্প্রতি টেকনাফে আটক ১৩ রোহিঙ্গার পেটের ভিতর থেকে ৪৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সীমান্ত অতিক্রম করা ২৩ রোহিঙ্গাসহ ২৬ জনকে আটকের পর এক্স-রের সহযোগিতায় এদের মধ্যে ১৩ রোহিঙ্গার পেটে ইয়াবার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তারা একেকজন পেটে ৩ হাজার পিসেরও বেশি ইয়াবা বহন করে বিনিময়ে ২০ হাজার টাকা করে পেয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল।
আর যারা ধরা পড়েনা তারা ইয়াবা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে যায়। সেখান থেকেই এখন ইয়াবা সরবরাহ করা হয় চাহিদা মতো সারা দেশে। আবার হেলিকপ্টারে ইয়াবা পাচারের তথ্য আসায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেসরকারি ছয়টি হেলিকপ্টার সার্ভিসের মালিকদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন। এটি নিয়ন্ত্রনে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে, সাগরপথেও ফিশিংট্রলার ভর্তি ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ইতোমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এসব বিষয় প্রমান করে, আকাশ, জল ও স্থল সব পথেই ইয়াবা পাচারে সিদ্ধহস্ত কারবারিরা।
এ পর্যন্ত মাদক বিরোধী অভিযানে শুধু কক্সবাজারের ৮ উপজেলায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আনুমানিক ৯০ জন নিহত হয়েছেন। চলমান রয়েছে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াও। এরপরও থামছে না ইয়ারা পাচার ও কারবার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসেই কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়। এরসাথে জড়িত ৩১৩ জনকে গ্রেফতার এবং ১৫৫টি মামলা করা হয়েছে। মার্চেও উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১২ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট। আটকও রয়েছে শতাধিক। এপ্রিল মাসেও উল্লেখ করার মতো ইয়াবা উদ্ধার এবং আটক রয়েছে।
চলতি মাসের বিগত ৫ দিনেও প্রায় ৪লাখ ইয়াবা জব্দ করেছে শৃংখলা বাহিনী। আটকও হয়েছে বেশ কয়েকজন। ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণকারিদের তালিকায় ১ নাম্বারে থাকা তাহেরের পরিবার হতে দুদিন আগে ৬০ হাজার ইয়াবাসহ তার পরিবারের সদস্য আটক হয়। এরপর গুঞ্জন চলছে তালিকাভুক্তরা আত্মসমর্পণে কারান্তরিন হলেও নিরাপদে চলছে কারবার।
ইয়াবায় সংশ্লিষ্টদের মতে, মাদকবিরোধী অভিযানে এপর্যন্ত গডফাদার পর্যায়ের মূল কেউ গ্রেফতার বা নিহত হননি। আত্মসমর্পণেও নেই উল্লেখ যোগ্যকেউ। মূল ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় এটি বন্ধ হচ্ছে না। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো পরিচয়ে তারা প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর হঠাৎ বড়লোক হবার আশায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন কেউ। পরিবর্তন হচ্ছে কৌশল-রুট। তাই রাত-দিনে বঙ্গোপসাগর হয়ে সমুদ্রপথে দেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান।
অপর এক সূত্র মতে, বন্দুকযুদ্ধে নিহত ও আত্মসমর্পণের পর মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখন সরাসরি ঢাকা বা উত্তরবঙ্গে ইয়াবা পাঠাচ্ছে। জলপথই এ মাধ্যমের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সীমান্ত এলাকার স্থানীয় আতংকিত কারবারিরা একটু সন্তর্পণে পা ফেলায় ওপারের ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে এখন টার্গেট করছে। ব্যবহার করা হচ্ছে লোভী বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের।
ক্যাম্পের লাখো ঝুপড়ি ঘরকে এরা ইয়াবা মজুদের নিরাপদ আস্তানা বলে জ্ঞান করছে। নানা ভাবে আত্মগোপন কিংবা প্রকাশ্যে থাকা তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি, তার ভাই কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, হাজী সাইফুল করিম, জালিয়াডপাড়ার জাফর আলম প্রকাশ টিটি জাফর, জাফর আহমদ চেয়ারম্যান ও তার ছেলে টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাহান মিয়া, বাহারছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও তার ভাই রফিক উদ্দিন, উখিয়ার সদস্য মোস্তাক আহমদ, নুরুল হক ভুট্টোসহ চিহ্নিতদের প্রশাসনের কজ্বায় এনে সহযোগী হাতগুলো রদকরা গেলে ইয়াবা আগ্রাসন প্রায় বন্ধ হবে।
আবার সোর্স বলে পরিচিত একটি চক্রের কারণে ইয়াবার প্রসারতা থামছে না বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। সোর্স হয়ে যারা ইয়াবা ধরিয়ে দেন তারা ১০% কমিশন পান। তাদের নগদ টাকা দেয়ার সুযোগ থাকেনা বলে লাখে ১০ হাজার ইয়াবা সোর্সদের হাতেই তুলে দেয়া হয়। কমিশন পাওয়া ইয়াবা আবার খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে তারা।
জনশ্রুতি রয়েছে, অনেক সময় আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যরা উদ্ধার করা ইয়াবা পুরো পরিমাণ উপস্থাপন করেন না। একটি অংশ রেখে দিয়ে তা সোর্সের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন। ফলে, ইয়াবার চাহিদা ও যোগান বন্ধ হয় না।
ইয়াবাবিরোধী অভিযান ও কারবারিদের আত্মসমর্পণের পরও ইয়াবা পাচার থামছে না এটা স্বীকার করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, উৎসমূল ও চাহিদা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ইয়াবা আসা পুরোপুরি থামানো যাবে না। সীমান্ত শহরসহ পুরো জেলায় মাদক কারবারির তালিকা দীর্ঘ। প্রাণঘাতি অভিযানের পরও যখন ইয়াবা থামছে না, তাই বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
তিনি বলেন, বড়-ছোট মিলিয়ে ১০২ জন আত্মসমর্পণ করেছে। আরো শতাধিক আত্মসমর্পণের জন্য উদ্যোগী হয়েছে। যারা এলো এবং আসছে তাদের সহযোগি হাতগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। দীর্ঘ সময়ে চলে আসা অনৈতিক এ কারবার হঠাৎ করে শতভাগ বন্ধ করা দু:সাধ্য। তবে, ক্রমান্বয়ে এটি সফলতা পাবে এমনটি আশা করছি আমরা।
চলমান সময়ে কারবারিদের শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদ্বারা সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না শৃংখলা বাহিনীর অসৎ কোন সদস্য মাদক কারবারিদের সহযোগিতা দিচ্ছে না। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করতেও আমরা কাজ করছি। শৃংখলাবাহিনীর যে সদস্য একাজে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাকেও মাদককারবারির ভাগ্যই বরণ করতে হবে। এতে কোন ছাড় থাকবে না।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর