সম্পাদকীয় »
মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলো আরও একটি বছর। আজ সূর্যোদয়ের কিরণছটায় উদ্ভাসিত হবে নতুন বছরের প্রভাত। সেই আলোয় অভিযাত্রা হোক সমৃদ্ধি ও মানবিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে।
বিগত বছরটি ছিলো করোনা অভিঘাত পরবর্তী সময় এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা ও অর্থনৈতিক সামাজিক সংকট মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এই দুটির প্রভাবে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে অসহায় করে তুলেছে। সরকার দরিদ্র ও নিম্ন বিত্তদের কষ্ট লাঘবে গ্রাম শহরের ১ কোটি পরিবারকে কয়েকটি নিত্যপণ্য সরবরাহ করেছে। সস্তা মূল্যে ওএমএস কর্মসূচি চালু রয়েছে। গত বছর দেশে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন সন্তোষজনক হয়েছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী রেমিটেন্স প্রবাহে উত্থান-পতন ছিলো, বছরের শেষে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বিগত বছরে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সক্ষমতার প্রতীক পদ্মাসেতুর উদ্বোধন হয়েছে, এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ দ্রুত ও সহজতর হয়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের জেলাগুলো সমৃদ্ধ হতে শুরু করবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণ দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। পদ্মা সেতুর পর উন্নয়নের আর একটি বড় মাইলফলক ঢাকায় মেট্রোরেল চালু। জাপানের প্রতিষ্ঠান জাইকার অর্থে নির্মিত মেট্রোরেল ঢাকার যানজট ও পরিবেশ দূষণ কমাবে। কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল এর অধিকাংশই শেষ হয়েছে গত বছরে।
গত বছরে দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গৃহহীনে গৃহদান’ কর্মসূচি দেশে বিদেশে প্রশংসা পেয়েছে। দেশে সড়ক ও সড়ক সেতুর নির্মাণ হয়েছে ব্যাপকভাবে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী একযোগে ১০০টি সড়ক সেতু উদ্বোধন করেছেন।
বিগত বছরটিতে নতুন আইন অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ৪ জন নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব নিয়েছেন। স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামোগত অগ্রগতি হয়েছে, করোনার টিকাদান কর্মসূচি সফল ছিলো, করোনা দুর্বল হলেও নির্মূল হয়নি, চীনে করোনার নতুন উপধরন দেখা দেওয়ায় শঙ্কা বেড়েছে, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। গত বছর ডেঙ্গুর আক্রমণ প্রবল ছিলো।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ নেই। রেলপথেও দুর্ঘটনা বেড়েছে।
গত বছর রাজনীতির ক্ষেত্রে উত্তাপ ছিলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন শেষ হয়েছে ডিসেম্বরে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বছরের অনেকটা সময় আন্দোলনে ছিলো। গত ডিসেম্বরে বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস ও রিজভিসহ অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। বিএনপি সংসদ সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঘটনাবহুল ছিলো বছরটি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে অর্থনৈতিক দুর্দশায় ফেলেছে। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের ফলাফলে রাজাপাকসের পারিবারিক শাসনের অবসান হয়েছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকার ক্ষমতা হারিয়েছে, নেপালের সাধারণ নির্বাচনে ঝুলন্ত সরকারের আশঙ্কা প্রবল হয়েছে, ব্রিটেনের নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কনজারভেটিভ পার্টির ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই প্রথম জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কোনোরূপ বিরোধিতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। মিশরে জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু তহবিল গঠনে ধনী দেশগুলি সম্মত হয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছে। ক্রিকেটে ভারতের সাথে টেস্ট হারলেও ওয়ান ডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা।
বছর শেষের ২দিন আগে ফুটবলের রাজা ‘পেলে’ মৃত্যুবরণ করেছেন। বিগত বছরটিতে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। সামাজিক নানা অপরাধও বেড়েছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সামাজিক সুস্থিরতা প্রয়োজন। প্রয়োজন শিশু, নারী, আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা। অপরাধ, সন্ত্রাস, মাদক, মানবপাচার, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সমাজে বৈষম্য হ্রাস, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কর্মসূচি নিতে হবে। সমাজ ও রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা, উদার চিন্তা প্রয়োজন। সহনশীল, সমৃদ্ধ ও মানবিক সমাজ গড়ার কাজ শুরু হোক নতুন বছরে।
ইংরেজি নববর্ষে আমরা দেশের সকল মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।