spot_imgspot_img
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত। রেজি নং-৯২
মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর ২০২৩
প্রচ্ছদমতামতমাস্টার দা সূর্য সেন : এক অসীম সাহসী বীরের ইতিহাস

মাস্টার দা সূর্য সেন : এক অসীম সাহসী বীরের ইতিহাস

spot_img

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম »

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি বাঙালির জন্য শোক দিবস, ইতিহাসে কালো দিবস। দিন তারিখের হিসেবে ১৯৩৪ সালের এই দিনে তাঁর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। সূর্যসেন ছিলেন অবিভক্ত ভারতের এক স্বাধীনতাকামী অগ্নি বীর পুরুষ, মহান সৈনিক। উপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে যাঁরা স্বাধীনতার মুক্তির স্বাদ আনতে চেয়েছিলেন তাঁদেরই একজন মাস্টার দা সূর্য সেন।

এই বীর পুরুষের জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান থানার ১৮৯৪ সালে। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী। সূর্যসেনের বাল্যকাল এবং কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামেই। পড়াশোনা করেছেন রাউজানের দয়াময়ী বিদ্যালয়ে, নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল হাইস্কুলে, চট্টগ্রাম কলেজে এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে।
তিনি যখন নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজানের ছাত্র সেই সময়েই বাংলার রাজনীতি বেশ উত্তাল। বাংলায় বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন চলছে।

এরপর যখন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি এ পড়তে যান তিনি তাঁর শিক্ষক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন।
১৯১৮ সালের দিকে তিনি চট্টগ্রামে ফেরত আসেন ন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরিচিতি লাভ করেন মাস্টার দা হিসেবে। এই সময় তিনি যুগান্তর দলকে সক্রিয় করে তোলেন। এর সঙ্গে অনুশীলনকেও যুক্ত করেন।

ক্রমাম্বয়ে তিনি সহিংস আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষদের উজ্জীবিত করেন। ছাত্র ধর্মঘট, হরতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আদালত বর্জন, সভা সমাবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে উপনিবেশ হঠানোর তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। জনগণকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন।

এভাবে চলতে চলতে এসে গেল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। মাস্টার দা সূর্যসেন তাঁর দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগারে হানা দেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করেন বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী মাস্টারদা সূর্যসেন ওই পতাকার তলে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ছিল চারদিন।

১৯৩০ সালের ২০ এপ্রিল রোববারের দি বেঙ্গলী পত্রিকায় চট্টগ্রাম বিদ্রোহের খবর ছাপা হলো লিড নিউজ দিয়ে। যেখানে লেখা হলো: “CHittagong Armouries Raided by 100 Insurgents” পত্রিকার আরো শিরোনাম করা হলো: Six persons shot dead ; Railway and Telegraphic communications cut off; Bengal Ordinance Revived: Viceroy’s Proclamation ; Eastern Frontier Rifles leave for Chittagong; Governor Hastens Back to Calcutta from Siliguri; Civilian Employees Safe.

এতেই বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনের কতটা ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাস্টার দা সূর্যসেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে থাকলো না। সূর্যসেনসহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ব্রিটিশরা তাকে কিছুতেই ধরতে না পারায় পরে এ পুরস্কারের পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়। ১৯৩০ সালের ১ মে চট্টগ্রামের জেলাশাসক এইচ.আর.উইকিনসন বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে গোপন পত্রে লেখেন,”Revolutionary outbreak in Chittagong during which events occurred which have no parallel in Bengal since the mutiny of 1857. It was a declaration of war against His Majesty the king by a body of armed and disciplined men calling themselves the Chittagong branch of the Indian Republic Army. They succeeded in affecting a complete surprise.”

কিন্তু সূর্য সেন ধরা পড়ে গেলেন ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চট্টগ্রামের নিজ গ্রাম গৈরালার আরেক বিপ্লবী ব্রজেন সেনের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন কল্পনা দত্ত, সুশীল এবং মণি দত্তকে নিয়ে। পরম যত্নে তাঁদের আগলে রেখেছিলেন সে বাড়ির বড়বধূ ক্ষিরোদপ্রভা । এই আশ্রয় ছিল ১৯৩৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে প্রতিবেশী নেত্র সেন সরকারি পুরস্কারের দশ হাজার টাকার লোভে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেয়। পরদিন সমস্ত সংবাদপত্রের হেডলাইন ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকায় আবারো বড় করে খবর ছাপা হলো: “ গৈরালা নামক গ্রামে সূর্য সেন গ্রেফতার।”

শুরু হলো বিচারিক কার্যক্রম। নিয়তির পরিহাসের কাছেতিনি হার মানলেন। ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি হলো মাস্টারদা সূর্য সেনের |

ফাঁসির আগে হাতুড়ি মেরে ভেঙে দেওয়া হল মাস্টারদার দাঁত,মেরে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল দেহের সব জয়েন্ট। এত যন্ত্রণা সহ্য করেও ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারী কারাগারে অন্তিম রাত্রের শেষ বাণীতেও মাস্টার দা সূর্য সেন বললেন “What shall I leave for you? Only one thing, that is my dream, a golden dream – a dream of free India. How auspicious a moment it was, when I first saw it! Throughout my life most passionately and untiringly, I have pursued it like a lunatic…”

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের এই ফাঁসির মঞ্চে সেদিন আরেকজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। তিনিও ছিলেন সূর্য সেনের সহগামী। নাম তারকেশ্বর দস্তিদার । ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়।

সূর্যসেনকে চট্টগ্রামের যেখানে ফাঁসি দেয়া হয়, এখন সেটা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে কিছুদূর এগোলেই প্রায় ১০ ফুট উঁচু একটি দেয়াল। ধূসর দেয়ালে মাস্টার দা সূর্যসেনের রঙিন প্রতিকৃতি। দেয়ালের সামনেই সাদা রং করা ফাঁসির মঞ্চ। বেদিটা ঢেকে রাখা হয়েছে টিন দিয়ে। মঞ্চের পাশেই একটা স্মৃতিফলক। সেখানে লেখা আছে, ‘সংরক্ষিত ঐতিহাসিক নিদর্শন: ১৯৩৪ সনে কার্যকর, মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসির মঞ্চ।’

এরপর গত ৮০ বছরে এখানে আর কোনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। তাঁর মৃত্যুদিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করতে চাই।

লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাপস্টোন ফেলো (২০১৮), ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুন

spot_img

সর্বশেষ