ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম »
ইতিহাসের ছাত্রদের একটি প্রশ্নের উত্তর শিখতে হয় কিংবা পরীক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণভাবে শিখতে হয় সেটা হলো বাংলার নবজাগরণ, রাজা রামমোহন রায়, ব্রাক্ষ্ম ধর্ম কিংবা তত্ত্ববোধিনী সভার। প্রায়ই মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয় তত্ত্ববোধিনী সভার প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? উত্তর আমাদের সকলের জানা – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এর সম্পর্কে এর বাইরে আর দুয়েকটা প্রশ্ন করলে আমরা থেমে যাই। তিনি কেন তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত করেন? কিংবা রাধাকান্ত দেব তাঁকে কেন মহর্ষি উপাধি দিয়েছিলেন? রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল- এগুলো সম্পর্কে ইতিহাসের ছাত্র হলেও সবাই জানবে এটা একেবারে আশা করাই যায় না। অথচ ইতিহাসের অনেক গল্প এগুলোতে জড়িয়ে থাকে। যদি একবার জানা যায়। তাহলে কিন্তু ভোলাটাই কঠিন। এই যেমন ধরা যাক রাজা রামমোহনের সঙ্গে দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের সম্পর্ক শুরুর দিক কিংবা কিভাবে তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা হলো সেটা যদি আমরা গল্পের ভেতর দিয়ে শুনি।
গল্পটা হলো, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তখন বয়স মাত্র ১২ বছর। দুর্গাপুজার সময়। তাঁকে যেতে হলো রাজা রামমোহনের বাড়িতে। পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আদেশে রামমোহন রায়কে দুর্গাপুজার নিমন্ত্রণ করতে গেছেন। এটা সেই সময়ের রীতি। অবস্থাপন্ন বাড়ির দুর্গা পুজায় নিমন্ত্রণ করা হতো চিঠি দিয়ে। আয়োজনও হতো জমজমাট। নামকরা ওস্তাদ, শিল্পীদের নাচ গানের আসর বসত। আর সঙ্গে থাকত রাজসিক খাওয়া দাওয়া।
দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর পারিবারিক নিমন্ত্রণ পত্র হস্তান্তর করলেন রামমোহন রায়কে। কিন্তু রামমোহন রায় খুব বিস্মিত হলেন নিমন্ত্রণ পত্র পেয়ে। তিনি বলে উঠলেন, “ আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?” কারণ রাম মোহন রায়ের প্রতিমা পুজায় বিশ্বাস কিংবা আস্থা ছিল না ।
যেহেতু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে এজন্য কৌশলী হয়ে নিমন্ত্রণ পত্র প্রত্যাখ্যানও করলেন না আবার গ্রহণও করলেন না। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর ছেলে রাধা প্রসাদের কাছে পাঠালেন।
রাধাপ্রাসাদ নিমন্ত্রণ পত্র গ্রহণ করলেন। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জলযোগ করালেন। রাধা প্রসাদ দেব সেই পুজার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন।
এই ঘটনায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিশোর বয়সে সেই প্রথম দাগ কেটেছিল। ক্রমাম্বয়ে তিনি একেশ্বরবাদ চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৮৩৯ সালের ৬ অক্টোবর তিনি তত্ত্বরঞ্জিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে সভার নতুন নামকরণ করেন তত্ত্ববোধিনী সভা।
তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্দেশ্য ছিল ‘উপনিষদ ও বেদ’ ভিত্তিক ধর্মালোচনা। আরও পরে ১৮৪২ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজ সমম্বিত হয় এবং তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজ পরিচালনা ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তত্ত্ববোধিনী সভা নামে পত্রিকা প্রকাশ শুরু হলো।
তত্ত্ববোধিনী সভা পত্রিকায় উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন এবং তাঁদের লেখার মাধ্যমে তখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। এর লেখক ও পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন সংস্কারপন্থী। বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও জ্ঞানবিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব এবং দর্শনবিষয়ক মূল্যবান রচনাও এতে প্রকাশিত হতো। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাঙালিদের অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের উপযুক্ত করে নিজেদের গঠন করার আহ্বান জানিয়ে এ পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতো। এভাবে তখনকার বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতিতে এ পত্রিকা বিশেষ অবদান রাখে।
আবারো ফিরে আসি রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলোচনায়। রাজা রামমোহন রায় যখন ইংল্যান্ড যাত্রা করেন তখন সকলেই এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। দেবেন্দ্রনাথ তখন কিশোর । প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি আসেন নি। এতে রাম মোহন রায় অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি জানালেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা না করে তিনি বিলাত যাবেন না। শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এলেন। রাজা রামমোহনের সঙ্গে দেখা হলো। কিন্তু এটাই ছিল দুইজনের শেষ দেখা। কারণ ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে রাজা রাম মোহন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু সেই দিনের শেষ দেখার স্মৃতি কোন দিন ভোলেন নি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন বেখেয়ালী , বেহিসাবী এবং ভোগ বিলাসী। তাঁর ভোগ বিলাসী জীবনযাপনের কারণে এক সময় ঠাকুর পরিবারের কার টেগোর কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার এই দেনা থেকে মুক্তির জন্য ঠাকুর পরিবারের বেলগাছিয়া ভিলাসহ অনেক বাড়ি, আসবাব ও সম্পত্তি নিলামে তোলেন। তারপরেও পিতার সমস্ত দেনা তিনি শোধ করেছিলেন। যাতে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় ৪০ বছর।
পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর পুত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “আমার জন্মের কয়েক বৎসর পূর্ব হইতেই আমার পিতা প্রায় দেশভ্রমণেই নিযুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়। মাঝে মাঝে তিনি কখনো হঠাৎ বাড়ি আসিতেন; সঙ্গে বিদেশী চাকর লইয়া আসিতেন; তাহাদের সঙ্গে ভাব করিয়া লইবার জন্য আমার মনে ভারি ঔৎসুক্য হইত। …যাহা হউক, পিতা যখন আসিতেন আমরা কেবল আশপাশ হইতে দূরে তাঁহার চাকরবাকরদের মহলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কৌতূহল মিটাইতাম। তাঁহার কাছে পৌঁছানো ঘটিয়া উঠিত না।… বহুকাল প্রবাসে থাকিয়া পিতা অল্প-কয়েক দিনের জন্য যখন কলিকাতায় আসিতেন,তখন তাঁহার প্রভাবে যেন সমস্ত বাড়ি ভরিয়া উঠিয়া গম্ গম্ করিতে থাকিত। দেখিতাম, গুরুজনেরা গায়ে জোব্বা পরিয়া, সংযত পরিচ্ছন্ন হইয়া, মুখে পান থাকিলে তাহা বাহিরে ফেলিয়া দিয়া তাঁহার কাছে যাইতেন। সকলেই সাবধান হইয়া চলিতেন। রন্ধনের পাছে কোনো ত্রুটি হয়, এইজন্য মা নিজে রান্নাঘরে গিয়া বসিয়া থাকিতেন। বৃদ্ধ কিনু হরকরা তাহার তকমাওয়ালা পাগড়ি ও শুভ্র চাপকান পরিয়া দ্বারে হাজির থাকিত। পাছে বারান্দায় গোলমাল, দৌড়াদৌড়ি করিয়া তাঁহার বিরাম ভঙ্গ করি, এজন্য পূর্বেই আমাদিগকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। আমরা ধীরে ধীরে চলি, ধীরে ধীরে বলি, উঁকি মারিতে আমাদের সাহস হয় না।” কবিগুরুর লেখা থেকেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
আজকের যে শান্তিনিকেতন সেটা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরই কেনা সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। দেবেন্দ্রনাথ বীরভূমের প্রভাবশালী জমিদার রায়পুরের সিনহাদের বাড়িতে যেতেন মাঝে মাঝেই। এ রকম এক সফরে মহর্ষি যখন বোলপুর হয়ে রায়পুরে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বিস্তৃত এলাকাজুড়ে আমের বাগান ও জঙ্গল দেখতে পান। এ স্থানটি তখন ‘ভুবনডাঙার মাঠ’ নামে পরিচিত ছিল এবং এখনো তা-ই আছে। সে আমলে অঞ্চলটি ডাকাত ও খুনিদের আস্তানা ছিল। সাধারণ মানুষ দিনের বেলায় এ জায়গা পার হতে ভয় পেত।
স্থানটির বিশালতা মহর্ষির মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে। বিশেষত একটি ছাতিম গাছ। মহর্ষি তার লটবহরকে থামতে নির্দেশ দেন এবং ছাতিম গাছের তলায় ধ্যানে বসেন। এটা তার মনে প্রশান্তি আনে। জায়গাটি তার খুব পছন্দ হয় এবং ঠিক সেখানে বসে তখনই তিনি এখানে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই স্মৃতিকে ধারণ করে লিখলেন, “এই আশ্রমই আমাদের নিকট তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। বাহিরের কলকোলাহল হইতে দূরে অবস্থিত হইলেও মানুষের অন্তরতম কল্যাণ চিন্তা করা ইহার কাজ। শান্তিনিকেতন আশ্রমের পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়া তাঁহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবোধ ও জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যোপলব্ধির পরিচয় পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বারা তিনি কখনো কাহাকেও প্রতারিত করিতেন না। কোনো অবস্থাতেই তিনি শাশ্বত আনন্দে তাঁহার যে অবিচল বিশ্বাস ছিল তাহা ক্ষুন্ন হইতে দিতেন না। তিনি জানিতেন যে, বন্ধন মুক্তি ব্যতীত আত্মোন্নতি সম্ভবপর নহে। তিনি এই আশ্রমের ভিতরে সেই মুক্তির ভাব সঞ্চারিত করিয়া গিয়াছেন। কৃত্রিম বন্ধনে সত্য যাহাতে শৃঙ্খলিত না হয় তজ্জন্য আমার যথাশক্তি চেষ্টা আমি করিয়াছি। আমার পিতার ন্যায় আমিও বিশ্বাস করি যে স্বাধীনভাবে পরিবর্ধিত হইবার সুযোগ না পাইলে আত্মা বা মন কখনো চরম সার্থকতা লাভ করিতে পারে না। আমি তাঁহার নিকট আমার ঋণের কথা কখনো বিস্মৃত হইতে পারি না। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করিতে এবং সত্যকে সকলের উপর স্থান দিতে তিনিই তাঁহার জীনবাদর্শ দ্বারা আমাকে শিখাইয়াছেন।”
আজ এই মহান পুরুষের মৃত্যু দিবস। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি (৬ই মাঘ ১৩১১ বঙ্গাব্দ) তারিখে ৮৮ বৎসর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস করেন।
তাঁর স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাপস্টোন ফেলো (২০১৮), ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ঢাকা