আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান »
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। আলীকদম নাম নিয়ে যেমন নানান কথা, উপকথা আর অভিমত চালু আছে, তেমনি রহস্যময় এই গুহা নিয়েও মজার মজার সব গল্প আর কিংবদন্তি পাওয়া যায়।
আলীকদম সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মাতামুহুরী-টোয়াইন খাল ঘেঁষে দুই পাহাড়ের চূড়ায় এই গুহার সৃষ্টি। এলাকাবাসীর কাছে এই গুহা ‘আলীর সুরম’ নামে পরিচিত। সরকার এই গুহাকে পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখানে মূলত তিনটি গুহা রয়েছে। তবে, শুধু যে সুড়ঙ্গটার নাম আলীর নামে তা কিন্তু নয়, যে পাথুরে পাহাড়ে এই গুহার অবস্থান তার নামও আলীর পাহাড় আর উপজেলার নাম আলীকদম। এই আলীকদম, আলীর পাহাড় আর আলীর গুহা একসূত্রে গাঁথা বলে ধারণা করা হয়। তবে কখন কিভাবে দুর্গম পাহাড়ে এমন অদ্ভূত সুন্দর গুহা তৈরি হলো তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য বা নথি পাওয়া যায় না। ফলে আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে রহস্যের শেষ নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, আলীকদমের অবস্থান বান্দরবান থেকে ১১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে। পাহাড়ের পর পাহাড় পাড়ি দিয়ে আলীর সুড়ঙ্গে যেতে হয়। সম্প্রতি ডিম পাহাড়ের ওপর দিয়ে নির্মিত দেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা দিয়েও এখানে যাওয়া যায়। এ রাস্তার মাথায় পানবাজার এলাকা থেকে পূর্ব দিকে মাতামুহুরি নদীর তীরে আলীর পাহাড়ের অবস্থান। আলীকদম শহর থেকে যার দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। বর্তমানে যাতায়াতের সুবিধার্থে তৈন খালের উপর দিয়ে একটি ব্রিজ, রাস্তা এবং সিঁডি নির্মাণ করা হয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, আলোহক্যডং থেকে আলীকদম নামটির জন্ম। যার অর্থ পাহাড় আর নদীর মধ্যবর্তী স্থান। বান্দরবানের রাজা বোমাং সার্কেল চিফ এর নথিপত্রে ও পাকিস্তান আমলের মানচিত্রে আলোহক্যডং নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো মানচিত্রেও (Ensea Det Bengalla) পর্তুগীজ পণ্ডিত জোয়াও জে বারোজ (Jao De Barros) আলোহক্যডং নামটি ব্যবহার করেছেন। আরকানি ভাষায় অনেক পাহাড় ও জায়গার নামে ডং, থং বা দং উপসর্গ জুড়ে আছে। সম্ভবত, ডং মানেই পাহাড়। তাই ধারণা করা হয়, তাজিংডং ও কেউক্রাডং পাহাড়ের মতোই আলোহক্যডং একটি পাহাড়ের নাম, যা কালক্রমে আলীকদম নাম নিয়েছে।
এদিকে অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টিএইচ লুইন এর মতে, ALLEY KINGDOM থেকে ALIKADAM নাম হয়েছে। তার মতে, ALLEY অর্থ দমন, আর KINGDOM অর্থ রাজ্য। বাংলায় মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এখানে ক্ষুদ্র এক রাজ্য শক্তিকে করায়ত্ব বা দমন করেন। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পাননি আমলে এ অঞ্চলের নাম হয় ALLEY KINGDOM বা দমন করা রাজ্য। যা পরবর্তীতে আলীকদম নামে টিকে থাকে।
ইতিহাস বলছে, নবম শতাব্দী থেকে আরাকানি শাসনে থাকা আলীকদম পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বাংলার সুলতান জালালউদ্দিনের করায়ত্ব হয়। ১৭৫৬ সালে মুঘলরা এ অঞ্চল জয় করলে আরাকানি শাসনের কফিন শেষ পেরেক ঠোকার কাজটি হয়ে যায়। আরাকান রাজ কং হ্লা প্রুকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে স্ব-পরিবারে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে অনেক আগে। শাসন পরিচালনার ফায়দা তুলছে ১৮ জন আরকানি রাজা মুসলিম উপাধি গ্রহণ করে ছিলেন। এদের মধ্যে ১৪৩৪-১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন রাজা মাং খারি। তার মুসলিম উপধি ছিল আলী খান। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব পরিচালনাকারী রাজা থাজাথা’র মুসলিম উপাধি ছিল আলী শাহ্। এ দুই নামের প্রভাবে আলীকদম নামটি এসে থাকতে পারে।
অপর এক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, আরবিতে কদম অর্থ পা। প্রয়োগ ভেদে যার অর্থ পদাচারণাও হতে পারে। আলী নামের কেউ একজন কোনো এক রসময় এ অঞ্চলে পা রেখে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তার নামের সঙ্গে কদম শব্দটি যুক্ত হয়ে আলীকদম নামটির জন্ম। তবে এমনও ধারণা প্রচলিত যে, হযরত শাহজালাল এর নেতৃত্বে ৩৬০ আউলিয়া ধর্মপ্রচারের জন্য সিলেট অঞ্চলে এলে তাদের একটি অংশ পার্বত্য এলাকায় আসেন, যাদের কারো নামের আলী উপাধি থেকে আলীকদম নামের জন্ম।
যেভাবে যাবেন আলীকদম
ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদম যেতে পারেন। শ্যামলী ও হানিফ বাস সরাসরি আলীকদম যায়। আলীকদম পর্যন্ত ভাড়া ৮৫০ কিংবা ১০০০ টাকা। বিকল্প হিসেবে কক্সবাজারগামী যেকোনো বাসে উঠে চকরিয়ায় নেমে যেতে পারেন আলীকদমে। চকরিয়া থেকে আলীকদম যাওয়ার অসংখ্য লোকাল বাসও রয়েছে। এসব বাস প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আলীকদমের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। যদি প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করে যেতে চান তাহলে লোকাল জিপ অথবা চাঁদের গাড়ি করেও যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে লোকা ভাড়া নেবে ৬০-৬৫ টাকা। রিজার্ভ নিলে ভাড়া পড়বে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
থাকার ব্যবস্থা
আলীকদম উপজেলা রোডে ‘দ্য দামতুয়া ইন আবাসিক’ অথবা জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
আলীর গুহায় যেভাবে যাবেন
আলীকদম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মংচপ্রুপাড়ায় যেতে হবে। হেঁটে কিংবা ইজিবাইকে করে যেতে পারেন। মংচপ্রুপাড়ার পাশ দিয়েই রয়েছে টোয়াইন খাল। এই খাল পার হয়ে কিছুক্ষণ পাহাড় ও ঝিরিপথে হেঁটে আলীর সুড়ঙ্গে যেতে হবে। সময় লাগবে ২০-৩০ মিনিট। সবগুলো গুহা দেখা ও আসা-যাওয়ায় মোট সময় লাগবে তিন ঘণ্টার মতো।
নিরাপত্তা স্বার্থের লাগবে গাইড
আলীর গুহা বা আলীর সুড়ঙ্গে একা না যাওয়াই ভালো। সঙ্গে গাইড নিয়ে নেবেন। আলীকদম অংসখ্য গাইড পাওয়া যায়। তাছাড়া ঝিরিপথের শুরুতে অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকে। তবে আগে থেকেই কথা বলে নেবেন সব গুহা যেন ঘুরে দেখায়।
গুহার ভেতরের অংশে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি
গুহার ভেতরের কিছু অংশ বেশ সরু। গুহার ভেতরে গেলেই যেন এক অজানা রহস্য আপনাকে ঘিরে রাখবে। নতুন এক জগতের সঙ্গে পরিচয় হবে আপনার। ভেতরে যেতে অবশ্যই টর্চ কিংবা মশাল নিতে হবে। একেবারেই ঘুটঘুটে অন্ধকার এই গুহার ভেতরটা। গা ছমছম করা পরিবেশ এবং একেবারেই স্যাঁতসেঁতে এই গুহাগুলো।
যারা পাহাড়-নদী,ঝরনা আর অরণ্য পছন্দ করেন তাদের জন্য আলীকদম অনন্য আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট।