কাউছার আলম, পটিয়া »
মানহীন প্রমাণিত হওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য দ্রুত বাজার থেকে সরিয়ে ধ্বংস করতে উচ্চ আদালতের রায়ের পরও পটিয়ার বাজারের প্রতিটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ পণ্যগুলো।
আদালতের আদেশ এখনো হাতে পাইনি অজুহাতে বাজার থেকে ভেজাল পণ্য প্রত্যাহার করা দূরের কথা, বরং কোম্পানিগুলোর পরিবেশকরা বিভিন্ন বাজারে ও দোকানে পণ্যগুলো সরবরাহ করছে আগের মতোই। সরেজমিনে পটিয়া পৌর সদরের মুন্সেফ বাজার, কামাল বাজার সহ বিভিন্ন বাজার ও অলিগলির দোকানগুলোতে বিএসটিআইর মান পরীক্ষায় ভেজাল প্রমাণিত হওয়া ৫২ পণ্যের মধ্যে বেশিরভাগই বিক্রি হতে দেখা গেছে। দোকানিরা জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলোর পরিবেশকরা আগের মতোই দোকানে এসে মাল দিয়ে যাচ্ছে। আর ক্রেতারা না জেনে ওই পণ্য কিনছেনও।
গতকাল শুক্রবার পটিয়া থানা হাট,বাস স্টেশন মুন্সেফ বাজার কাঁচা বাজার , কামাল বাজার কাঁচা বাজার ও পটিয়ার শান্তির হাট,কমলমুসন্সির হাট,অামজুর হাট, গ্রামে গন্জের বিভিন্ন হাট বাজার ও এলাকার বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বিএসটিআইর পরীক্ষায় মানহীন পণ্যগুলো প্রতিটি দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে।
মুন্সেফ বাজারের ইদ্রিচ স্টোরে গিয়ে দেখা যায় এসিআইর লবণ, সিটি গ্রুপের তীর সরিষার তেল, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা সরিষার তেল, মেঘনা ও প্রাণ গ্রুপের হলুদের গুঁড়া, বাঘাবাড়ী স্পেশাল ঘি সাজানো রয়েছে। এসব পণ্য ফেরত নিতে কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে কেউ যোগাযোগ করছে কি না জানতে চাইলে বিক্রেতা বেলাল উদ্দীন বলেন, পণ্য ফেরত নেওয়ার কথা কেউ বলেনি। উল্টো কোম্পানির ডিলাররা পণ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতারাও কিনছেন।
এসব পণ্য যে মানহীন, ক্রেতাদের বেশিরভাগই তা জানেন না। শান্তির হাটের মুদি দোকানি ইব্রাহিম জানান, তার দোকানে এসিআইয়ের লবণ, রূপচাঁদা ও তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেল এখনো বিক্রি হচ্ছে। বিএসটিআই তালিকা প্রকাশ করার পরও পাইকারি বাজার থেকে তিনি এসব মাল কিনে এনে বিক্রি করছেন। কোনো কোম্পানির পণ্যের কোনো সংকট নেই, পণ্য সরবরাহও বন্ধ করেনি কোনো কোম্পানি। জানা যায়,বাজারে থাকা ২৭ ধরনের ৪০৬টি খাদ্যপণ্যের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ৫২টি নিম্নমানের ও সেগুলোয় ভেজাল রয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসব খাদ্যপণ্য বাজার থেকে জব্দ, প্রত্যাহার ও এর মানের উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৮ মে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটি’র (সিসিএস) পক্ষে হাইকোর্টে ওই রিট আবেদনটি করেন আইনজীবী শিহাবউদ্দিন খান।
রবিবার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ ১০ দিনের মধ্যে মানহীন ৫২ পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে ধ্বংস করার আদেশ দিয়ে বলেন, মানপরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে। বিএসটিআইর পরীক্ষায় মানহীন ৫২ পণ্যের মধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেডের প্রাণ লাচ্ছা সেমাই, প্রাণ হলুদের গুঁড়া ও প্রাণ কারি পাউডার।
এছাড়া মানহীন এসব পণ্যের মজুদের তথ্যও দেয়নি । প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপনন কর্মী হাবিব বলেন, অামরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি যে, আমাদের কয়েকটি পণ্যের গুণগত মান বিএসটিআইর নির্ধারিত মান অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কোম্পানির নিজস্ব ল্যাবে এবং একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃত ল্যাবে পণ্যের মান পুনঃপরীক্ষা করা হয়।
তাতে দেখা যায়, পণ্যের মান বিএসটিআইর মান অনুযায়ী রয়েছে। এরই মধ্যে পণ্যের মান পুনঃপরীক্ষা করতে বিএসটিআইকে চিঠি দিয়েছি, তাতে বিভিন্ন ল্যাবে করা ফলাফলও তুলে ধরা হয়েছে। আমরা আশা করি, বিএসটিআই ফের ওইসব পণ্যের মান পরীক্ষার মাধ্যমে জনমনে সব বিভ্রান্তি দূর করবে। আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যম থেকে আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। কিন্তু রায়ের কপি এখনো অামাদের অফিস কিংবা অামরা পাইনি। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কপি পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
তীর ব্রান্ডের সিটি গ্রুপের বিক্রয় প্রতিনিধি আলমগীর হোসেন গতকাল বলেন, ‘আমরা উচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনাগুলো মেনে চলব। মজুদ বা বাজারে কী পরিমাণ তেল রয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। হাইকোর্টের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তাই এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলা সম্ভব নয়।
রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের সরিষার তেলের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের মার্কেটিং নির্বাহী কামাল উদ্দিন বলেন, ‘২৮ এপ্রিল বিএসটিআই চিঠি দিয়ে আমাদের জানিয়েছে যে, রূপচাঁদা সরিষার তেলে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ৩ পিপিএম (প্রতি লিটারে ০.০০৩ মিলিলিটার) আয়রন বেশি আছে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘রূপচাঁদা সরিষার তেলের বীজ আহরণ থেকে বোতলে প্যাকেটজাত করার পুরো প্রক্রিয়ায় বাইরে থেকে কোনো প্রকার রাসায়নিক মেশানো হয় না।
এর অর্থ হচ্ছে, উপস্থিত আয়রন সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে এই তেলে উপস্থিত এবং তেলের গুণগতমান অক্ষুণ্ন রেখে এই আয়রন অপসারণ করা সম্ভব নয়। আবার মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতুর তালিকায় আয়রন নেই। আমরা এখন বিএসটিআইর পরবর্তি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
এসিআই সল্ট বিপণনের মার্কেটিং অফিসার স্বদেশ বড়ুয়া বলেন, ‘বিএসটিআই কদিন আগে বলেছে এসিআইর লবণে মান নেই। দুদিন পর বলবে মান ঠিক আছে। বাজারে যত ব্র্যান্ডের লবণ আছে, তাদের কেউই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে তাদের লবণ খাঁটি। তিনি বলেন, ‘হয়তো নির্দিষ্ট একটি ব্যাচের লবণে পিএইচ ভ্যালু বিএসটিআইর নির্ধারিত মান অনুযায়ী হয়নি।
এখন পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে যে, বাজারের থাকা এসিআইর লবণ মানসম্পন্ন। এসিআইর কোনো লবণ মজুদ নেই। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই তা বাজারে ছাড়া হয়। মধুবন লাচ্ছা সেমাই উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মধুবন ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র মার্কেটিং অফিসার অাশরাফুজ্জামান আদালতের রায়ের পর আমরা লাচ্ছা সেমাইগুলো শোরুম থেকে সরিয়ে রেখেছি। তবে কী পরিমাণ লাচ্ছা সেমাই মজুদ রয়েছে তা বলা সম্ভব নয়।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর/বি