spot_imgspot_img
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত। রেজি নং-৯২
সোমবার, ৫ জুন ২০২৩
প্রচ্ছদবৃহত্তর চট্টগ্রামধারণক্ষমতার ৮ গুণ বন্দি কক্সবাজার জেলা কারাগারে!

ধারণক্ষমতার ৮ গুণ বন্দি কক্সবাজার জেলা কারাগারে!

spot_img

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

কক্সবাজার জেলা কারাগারে ধারণক্ষমতা ৫৩০ জনের। কলাতলী বাইপাসে পাহাড় ঘেরা ১২ একর আয়তনের কারাগারটিতে ৪৯৬ পুরুষ এবং ৩৪ জন নারী বন্দি থাকার কথা। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে এ কারাগারে গড়ে বন্দি থাকছে ৪ হাজারের অধিক। এতে এক জনের জায়গায় রাত্রি যাপন করছেন ৮ জন বন্দি। ফলে মানবেতর ভাবেই রাত পার করছেন নানা অপরাধে কারান্তরিণ হওয়া বন্দিরা।

এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্গন বলে দাবি করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাই জামিন যোগ্য মামলাগুলোতে জামিন কিংবা নিস্পত্তি মূলক মামলা দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার কারাগারের তত্বাবধায়ক (জেল সুপার) মো. বজলুর রশিদ আখন্দ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ২০০১ সালে উদ্বোধন হওয়া ১২ দশমিক ৮৬ একর আয়তনের কারাগারে অভ্যন্তরের পরিমাণ ৮ দশমিক ০৯ একর আর বাইরের পরিমাণ ৪ দশমিক ৭৭ একর। এটির ধারণ ক্ষমতা ৫৩০ জন। চলতি বছরের শুরু থেকেই কারাগারে গড়ে বন্দি থাকছে ৪ হাজারের অধিক। প্রতিদিনই আসছে নতুন নতুন বন্দি। রয়েছে ভারতীয় ৪ নারী-পুরুষসহ মিয়ানমার নাগরিক রয়েছে ২৪৩ জন। এদের মাঝে ৫ জনের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে।

কারা তত্বাবধায়ক আরো বলেন, বন্দিরাও মানুষ। এভাবে একজনের জায়গায় প্রায় আটজন অবস্থান করা কষ্ট সাধ্য। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয় রাত না আসাই তাদের জন্য মঙ্গল। বন্দিদের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে জামিন যোগ্য মামলা গুলো দ্রুত জামিন দিতে জেলা বিচার বিভাগকে প্রায় অনুরোধ করা হয়। তারাও যথা সম্ভব জামিন দিচ্ছেন কিন্তু যতজন বের হয় তার চেয়ে ঢের বেশি নতুন বন্দি যোগ হয় কারাগারে। তাই আমরাও বিপাকে রয়েছি।

আদালত সূত্রের সাথে কথা বলে জানাযায়, রাষ্ট্রযন্ত্র মাদকের ছোবল থেকে প্রজন্মকে বাঁচাতে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পদ্ধতিতে এগুচ্ছে। তাই কক্সবাজারে কারান্তরিণ বন্দিদের মাঝে শতকরা ৭৫ জন মাদক মামলার আসামী। ৫ পিস থেকে ২০০ পিস নিয়ে আটক হওয়া মাদক ব্যবসায়ীদেরও জামিনের পূর্বে কম করে হলেও ২-৩ মাস কারান্তরিণ রাখা হয়।

সূত্র আরো জানায়, শুধু এসব মামলা নয়, মারামারি, জমি দখল বা অন্য অপরাধে কারাগারে থাকা আসামীরাও জামিন পান কম। কারণ তারা জামিনের জন্য আদালতে প্রসেস করলেও প্রতিপক্ষ সেখানে শক্ত বিরোধীতা করেন। ফলে বিচারক সহজে তাকে আর জামিন দিতে পারেন না। এভাবে কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউল করিম রেজা বলেন, এক জনের জায়গায় আট জনের অবস্থান করা চরম অমানবিক। কিন্তু ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি আসলে কারা কর্তৃপক্ষের করার কিছুই থাকে না। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায়, আইনী মারপ্যাঁচের কারণে বন্দির পরিমাণ কমা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী জেলার কারাগার গুলোতে কিছু বন্দি স্থানান্তর করা গেলে হয়ত এ সমস্যা থেকে কিছুটা উত্তরণ করা যেত। এখানেও সমস্যা দেখা দেয়। দরিদ্র বন্দি হলে, তাদের স্বজনরা দূরের জেলায় গিয়ে তাদের দেখে আসাও কষ্টসাধ্য।

কারাগারে আসা দর্শনার্থীরা জানান, দর্শনার্থী বসার জন্য সেমিপাকা বিশালাকার ঘর করে ফ্যানের নিচে সারিবদ্ধ টুলে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপরও প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কারাবন্দি স্বজনদের সাথে দেখা করতে হলে নির্ধারিত সময় অপেক্ষা করতে হয়। এসময় প্রাকৃতিক ডাক আসে। কিন্তু গণ-শৌচাগার ও পাবলিক টয়লেট না থাকায় চরম সমস্যার সম্মুখিন হয় নারী দর্শনার্থীরা। পুরুষরা যেকোন ভাবে প্রাকৃতিক ডাক সারলেও নারীরা সেটি পারে না বলে দূর্ভোগে পড়েন।

এছাড়াও, কারা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা থাকলেও বন্দিরাও কষ্ট পোহাচ্ছেন চিকিৎসক, বাথরুম ও সুপেয় পানি নিয়ে।

এত অভাব ও সংকটের পরও জামিনে আসা বন্দিরা বলছেন, ঘুমানোর জায়গার দূর্ভোগ ছাড়া কারাভ্যন্তরে ভোগান্তি ও সার্বিক পরিস্থিতি বদলেছে। আগে বিভিন্ন সেলের ইনচার্জ কর্তৃক আসামী ক্রয় এবং সিট বিক্রি বন্ধ (একটু খোলাসা করে শোয়া)। এখন বাই রুটেশনে বন্দিরা সব জায়গায় ঘুমান। ধুমপান থাকলেও ইয়াবা-গাঁজার বিকিকিনি নেই। রান্নার মাছ, মাংস ও তরিতরকারি কাটার জন্য শেডসহ মঞ্চাকারে পরিচ্ছন্ন স্থান তৈরী করা হয়েছে। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান, সমুদ্র সৈকতসহ নানা আলপনায় বদলানো হয়েছে কারাভ্যন্তরের দেয়াল। তাকালে মনে হয় চারুকলা বিভাগে রয়েছি। নেই আগের সেই ইলিশ ফাইল ও পাখির গোসল।

জামিনে বের হওয়া নারী বন্দি সাজেদা খানম বলেন, কারাগারে নারী বন্দিদের সাথে দুগ্ধপূষ্যসহ বেশ কিছু শিশু রয়েছে। সেসব শিশুদের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ পার্কের আদলে নানা খেলনাসহ সুযোগ সুবিধা রেখেছেন। সেখানে শিশুরা প্রাণবন্ত ভাবে খেলাধুলা করে।
সম্প্রতি আকস্মিক কক্সবাজার কারাগার পরিদর্শন করে মানবাধিকার চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে বন্দিদের সাথে কথা বলেন। জেলের অভ্যন্তরে পরিপাটি পরিবেশ, দেয়ালে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজের দৃশ্য এবং শিক্ষণীয় নানা আল্পনা, শিশু পার্ক, নতুন ভবন, রান্নাঘর, ক্যান্টিন, পতাকা মঞ্চ, দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

জেল সুপার বজলুর রশিদ আখন্দ বলেন, বিগত একযুগের সমীকরণ দেখে জেনেছি কারাগারটি শুরুর পর থেকে ২ হাজার পাঁচশ জনের নিচে কখনো আসেনি। এটি দিন দিন বাড়তে থাকায় কারাভ্যন্তরে নতুন ৬ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। ১২ কক্ষ বিশিষ্ট ভবনে ২০০ জনের ধারণ ক্ষমতা থাকছে। প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ভবনটি চলতি বছর কাজ শেষ হলে বন্দিরা একটু স্বস্তি পেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বর্তমান সরকারের চোখে কারাগার হলো অপরাধ শোধনাগার। রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলো পথ-এ শ্লোগানের মতোই আলোর পথের যাত্রি করে বের করার চেষ্ঠা করা হচ্ছে বন্দিদের।

বাংলাধারা/এফএস/এমআর

আরও পড়ুন

spot_img

সর্বশেষ